বেসরকারিকরণ— অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ সরকার থেকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর— উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম বিতর্কিত অর্থনৈতিক সংস্কার। সমর্থকরা একে দক্ষতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং আর্থিক স্বস্তির হাতিয়ার হিসেবে দেখেন; অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করেন এটি সরকারের ব্যর্থতার এক স্বীকারোক্তি, যেখানে সরকার স্বীকার করে যে তারা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আর পরিচালনা করতে সক্ষম নয়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সত্যিটা মাঝামাঝি অবস্থানে— বেসরকারিকরণ একদিকে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন, অন্যদিকে আর্থিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশলগত অভিযোজনও বটে।
জাতীয়করণ থেকে বেসরকারিকরণ: ইতিহাসের দোলাচল
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে বলা যায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বাজারমুখী উদারনীতির মধ্যে দোলায়মান এক যাত্রা।
১৯৭০-এর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমাজতান্ত্রিক নীতির অধীনে ব্যাংক, শিল্প ও ইউটিলিটি খাত রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে দুই শতাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান (SOE) দেশের অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে। উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু ফলাফল হয় উল্টো— অদক্ষতা, অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে। ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের চাপে পাকিস্তান প্রথম বৃহৎ বেসরকারিকরণ কর্মসূচি চালু করে। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভাটাইজেশন কমিশন ২০০৩ সালের মধ্যে ১৩২টি লেনদেন সম্পন্ন করে, যা থেকে প্রায় ৩৯৫ বিলিয়ন রুপি আয় হয়। কিন্তু ডন পত্রিকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এসব বিক্রির বেশিরভাগই স্থায়ী উন্নতি আনতে ব্যর্থ হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে থেকে যায় বা দুর্নীতির অভিযোগে পুনরায় বিক্রি হয়।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তানের ৮৮টি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ৭৩০ বিলিয়ন রুপিরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে— যা জাতীয় বাজেটে বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। তিন দশক পরও সরকার এসব অদক্ষ প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে— বেসরকারিকরণ কি সমস্যার সমাধান করেছে, নাকি কেবল সংস্কার বিলম্বিত করেছে?

বর্তমান বেসরকারিকরণ কর্মসূচি: আর্থিক প্রয়োজনের তাগিদ
বর্তমান সময়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বেসরকারিকরণ কোনো নতুন ধারণা নয়; বরং এটি তীব্র আর্থিক সংকটের ফলে গৃহীত এক বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। ঋণের বোঝা, আইএমএফের শর্ত, এবং জ্বালানি খাতে চক্রাকার ঋণের সমস্যা সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্তকে আরও জোরদার করেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার বেসরকারিকরণ থেকে ৮৬.৫ বিলিয়ন রুপি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা আগের বছরের ৮ বিলিয়নের প্রায় দশগুণ। সরকার আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ৫০টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিক্রির পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (PIA), বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (DISCOs) এবং বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ সালের পর থেকে কোনো বড় বেসরকারিকরণ আয় হয়নি, যা বাস্তবায়নে প্রশাসনিক অদক্ষতা ও রাজনৈতিক বাধার ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমান বেসরকারিকরণের যুক্তি মূলত আর্থিক— ক্ষতি কমানো, ভর্তুকি হ্রাস এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ। সেন্টারলাইন ইকোনমিক রিভিউ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শুধু পিআইএ বিক্রি করলেই প্রায় ৮০০ বিলিয়ন রুপির ঋণ হ্রাস এবং বছরে ৩০০ বিলিয়ন রুপির ভর্তুকি বন্ধ করা সম্ভব। একইভাবে, বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বিক্রি বা সংস্কার করলে বছরে আনুমানিক ৫০০ বিলিয়ন রুপি সাশ্রয় হতে পারে।
এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কিন্তু বেসরকারিকরণ কেবল অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়— এটি রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতারও পরীক্ষা, সরকার কতটা দক্ষভাবে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারে তার প্রমাণ।
বেসরকারিকরণের পক্ষে যুক্তি: কৌশলগত অভিযোজন ও দক্ষতা বৃদ্ধি
যখন বেসরকারিকরণ স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, তখন এটি ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি নয়, বরং এক কৌশলগত অভিযোজন। এতে সরকার তার মূল দায়িত্বগুলো— নিরাপত্তা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও অবকাঠামো— এ মনোনিবেশ করতে পারে, আর বাণিজ্যিক ঝুঁকি নিতে পারে বাজারনির্ভর বেসরকারি খাত।
আর্থিক স্বস্তি ও শাসনে মনোযোগ বৃদ্ধি
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের অর্থনীতিতে বিশাল আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাদের বার্ষিক গড় ক্ষতি ছিল ৫০০ বিলিয়ন রুপিরও বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি ভর্তুকি ও গ্যারান্টি বাজেট ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা হলে সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য বেশি সুযোগ পাবে।
২০২৪ সালের ব্রুকিংস রিপোর্টে বলা হয়, “বেসরকারিকরণ তখনই সফল হয়, যখন এটি রাষ্ট্রকে ভালোভাবে শাসন করতে সহায়তা করে— শুধু কম শাসন নয়।”
দক্ষতা বৃদ্ধির বাস্তব উদাহরণ
করাচি ইলেকট্রিক (K-Electric)-এর বেসরকারিকরণ পাকিস্তানে বাস্তব উন্নতির একটি দৃষ্টান্ত। একসময় ধারাবাহিকভাবে ক্ষতির মুখে থাকা প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারিকরণের পর বিদ্যুৎ অপচয় ৩৪% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে, কর প্রদানের হার বেড়ে যায়, এবং সেবার মান উন্নত হয়। যদিও কিছু বিতর্ক রয়েছে, তবু এটি প্রমাণ করে যে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ থাকলে বেসরকারি মালিকানায় দক্ষতা বৃদ্ধি সম্ভব।
একইভাবে, টেলিযোগাযোগ খাত— যা একসময় রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল— বেসরকারিকরণের পর দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০০১ সালে যেখানে মোবাইল ব্যবহারকারী ছিল ৩০ লাখের কম, সেখানে ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯০ মিলিয়নেরও বেশি। এই খাতের উন্নতি প্রমাণ করে যে বেসরকারিকরণ নতুন উদ্ভাবন ও প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধির অনুঘটক হতে পারে।
বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ
বর্তমানে টেলিকম, ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ খাতে মোট বিনিয়োগের ৮০%-এর বেশি বেসরকারি খাত থেকে আসে। ১৯৯০-এর দশকের ব্যাংক বেসরকারিকরণ— যেমন অ্যালাইড ব্যাংক ও ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড— পাকিস্তানের আর্থিক খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক ও লাভজনক করেছে।
বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি: বেসরকারিকরণ এক অক্ষমতার প্রতিফলন
দুর্বল শাসন ও স্বচ্ছতার অভাব
২০০২ সালের সংসদীয় তদন্তে প্রকাশ পায় যে প্রায় ৮০ বিলিয়ন রুপির বেসরকারিকরণ আয় অনুপস্থিত থেকে গেছে। তেল, সিমেন্ট, চিনি ও গাড়ি শিল্পের মতো একাধিক খাত বেসরকারিকরণের পর নতুন বেসরকারি কার্টেল গঠন করেছে। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির বদলে বাজারে নতুন একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়েছে।
প্রাইভাটাইজেশন কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অস্বচ্ছ মূল্যায়ন ও নীতির অসংগতি নিয়ে বারবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সাউথএশিয়া রিপোর্ট (২০২৫) উল্লেখ করে, “পাকিস্তানে বেসরকারিকরণ অর্থনীতির নয়, রাজনীতির বন্দি।”
সংস্কারবিহীন বিক্রির প্রবণতা
অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই বিক্রি করা হয়— ফলে সমস্যার স্থানান্তর ঘটে, সমাধান নয়। পাকিস্তান স্টিল মিলস (PSM)-এর আংশিক বেসরকারিকরণ এর স্পষ্ট উদাহরণ; কর্মী ছাঁটাই করা হলেও উৎপাদন পুনরুদ্ধার হয়নি, ঋণও কমেনি।

দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা ক্ষতি
বেসরকারিকরণের পর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর (যেমন CCP, SECP, FBR, SBP) কার্যকারিতা বাড়েনি। এর ফলে বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক চার্জ ও টেলিযোগাযোগ খরচ বেড়েছে। ফলে নাগরিকরা একদিকে করদাতা হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ভোক্তা হিসেবেও অতিরিক্ত ব্যয় বহন করছেন।
রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বার্থের সংঘাত
বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব, অভ্যন্তরীণ দরপত্র এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সুবিধা প্রদান জনবিশ্বাস নষ্ট করেছে। এর ফলে বেসরকারিকরণ একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং ক্ষমতার ঘনিষ্ঠদের পুরস্কারে পরিণত হয়েছে।
কাঠামোগত দুর্বলতা: মূল সমস্যা শাসনে
বেসরকারিকরণকে পাকিস্তানের বৃহত্তর প্রশাসনিক দুর্বলতা থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। দুর্বল প্রতিষ্ঠান— যেমন SECP, SBP ও FBR— কার্যকরভাবে নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাবে প্রতিটি নতুন সরকার পুরনো পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছে।
এর ফলে বাজার প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির বদলে অনেক খাতেই কার্টেল গঠিত হয়েছে— যেমন চিনি, সিমেন্ট ও জ্বালানি খাতে। রাষ্ট্রীয় অদক্ষতার জায়গায় এসেছে বেসরকারি শোষণ। সাধারণ নাগরিকদের জন্য এর অর্থ হলো— বেশি দাম, কম মান এবং কম জবাবদিহিতা।
বৈশ্বিক তুলনা: যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সাফল্য এসেছে
যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করছে, তখন উন্নত কিছু দেশ— যেমন নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও চীন— তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করছে কর্পোরেট ধাঁচের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাই অদক্ষতার প্রতীক নয়; সুশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো ফল দিতে পারে।
মূল বার্তাটি স্পষ্ট: সমস্যাটা মালিকানায় নয়, শাসনে।
উপসংহার: পশ্চাদপসরণ নয়, সংস্কার
পাকিস্তানে বেসরকারিকরণ একদিকে রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে এটি আর্থিক পুনর্গঠনের একটি উপায়। যেখানে এটি সফল হয়েছে— যেমন টেলিকম, ব্যাংকিং ও করাচি ইলেকট্রিক— সেখানে স্বচ্ছ নীতি, বিনিয়োগ প্রণোদনা ও জবাবদিহিতা ছিল। আর যেখানে ব্যর্থ হয়েছে— যেমন ইস্পাত, বিমান ও ইউটিলিটি খাত— সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অস্বচ্ছতা প্রধান কারণ।
অতএব, বেসরকারিকরণ নিজে কোনো ব্যর্থতা নয়; এটি ব্যর্থ হয় যখন তা অপব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। মূল প্রশ্ন হলো— বিক্রি করা উচিত কি না নয়, বরং কীভাবে করা উচিত। যদি স্বচ্ছতা, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ, এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করা যায়, তবে বেসরকারিকরণ কেবল দায়িত্ব থেকে পলায়নের প্রতীক হবে।
কিন্তু যদি এটি সংস্কারমূলক কাঠামোর মধ্যে সম্পন্ন হয়, তবে এটি কৌশলগত অভিযোজন হিসেবে কাজ করতে পারে— এমন এক ভারসাম্য যেখানে রাষ্ট্র ও বাজারের ভূমিকা পুনর্নির্ধারিত হবে।
মুবাশ্বির মির 



















