কর্মজীবনের নতুন সংজ্ঞা
নিয়া জোসেফ চান, তাঁর কাজের সঙ্গে সম্পর্কটা যেন বাবা-মায়ের মতো না হয়।
ড্যামারিয়ান বেন্টন সন্ধ্যা পাঁচটার পর কোনো অফিস ইমেল এর উত্তর দিতে চান না।
আর জেসিকা মোরান খোলাখুলি জানিয়ে দেন — তিনি সপ্তাহের রাতে পিকলবল প্র্যাকটিসে থাকবেন, তখন অফিসে যোগাযোগ করা যাবে না।
তাঁরা সবাই কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন। তবুও ধীর অর্থনীতি ও কমতে থাকা চাকরির বাজারের মাঝেও তাঁদের অগ্রাধিকার স্পষ্ট — কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য।
কোম্পানিগুলোর ব্যয় সাশ্রয় ও তরুণদের মানসিকতা
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বন্ধ করছে বা কর্মী ছাঁটাই করছে।
একই সময়ে তরুণ কর্মীরা (বিশেষত জেনারেশন জেড) এখনও কাজ-জীবনের ভারসাম্যকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তাঁরা আগের প্রজন্মের মতো নিয়োগকর্তার প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাতে আগ্রহী নন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সময় রিমোট কাজ বা বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ এই মানসিকতার পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

আনুগত্যের ধারণায় পরিবর্তন
গ্যালাপের সুস্থতা বিষয়ক গবেষক জিম হার্টার বলেন, “কর্মসংস্থানের অবস্থা কঠিন হলেও মানুষ এখন আগের চেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কম সংযুক্ত বোধ করছে।”
অনেক তরুণই মনে করেন — কোম্পানির প্রতি আনুগত্য দেখানো মানে ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দেওয়া, অথচ কোম্পানি প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় ছাঁটাই করবে।কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও ছাঁটাই তরুণ প্রজন্মকে আরও দৃঢ় করেছে এই বিশ্বাসে — কোম্পানির প্রতি আনুগত্য
ফিরিয়ে দেয় না কোম্পানি নিজেই।
নিয়া জোসেফের উপলব্ধি
হিউস্টনের ২৭ বছর বয়সী নিয়া জোসেফ আগে ভাবতেন, সোমবার সকালে কাজ থাকলে রবিবার রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া জরুরি।
কিন্তু একদিন বন্ধুদের সঙ্গে রাত দুইটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বুঝলেন, তিনি জীবনের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন।
তাঁর বাবা ছিলেন অধ্যাপক, যিনি প্রায় সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন; মা ছিলেন সামাজিককর্মী — তাই কাজ তাদের ব্যক্তিগত জীবনটাই গ্রাস করেছিল।
নিয়া বলেন, “আমার মনে হয়েছে, কাজ কখনো তোমাকে মুক্তি দেবে না — তুমি নিজেকেই কাজের কবল থেকে মুক্ত করতে পারো।”
প্রজন্মের পার্থক্য
জেনারেশন এক্স প্রজন্মের লোকেরা মনে করেন কঠিন সময়ে আরও বেশি পরিশ্রম করলেই নিরাপত্তা আসে।
কিন্তু জেনারেশন জেড বিশ্বাস করে, তাদের কাজের মানটাই মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত, সময় নয়।
এথোস ইনোভেশনের প্রতিষ্ঠাতা মার্সি মেরিম্যান বলেন, “আমাদের প্রজন্ম চাপের সময়ে আরও বেশি কাজ করত। কিন্তু তরুণরা জানে, শুধু দীর্ঘ সময় কাজ করলেই সাফল্য আসে না।”

গবেষণার তথ্য: বেতন নয়, ভারসাম্যই প্রধান
কেপিএমজির এক জরিপে দেখা গেছে — ১,১০০ জনের বেশি ইন্টার্নের মধ্যে বেশিরভাগই পূর্ণকালীন চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেতন নয়, বরং কাজ-জীবনের ভারসাম্যকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
জেসিকা মোরান, যিনি ২০২২ সালে কেপিএমজিতে ইন্টার্ন ছিলেন, বলেন,
“আমি সিনিয়রদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের বাস্তবিক কাজ-জীবনের ভারসাম্য কেমন। শুনে মনে হলো, এখানে মানুষ কাজের বাইরেও নিজেদের জন্য সময় পায়।”
এখন তিনি নিউ জার্সির শর্ট হিলসে কেপিএমজির সিনিয়র অডিট অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি নির্দ্বিধায় জানান, তাঁর সপ্তাহের রাতের পিকলবল অনুশীলন অপরিহার্য, এবং অফিসকে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হয়।
কমে আসছে কাজের সময়
গ্যালাপের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন কর্মীরা ২০২৪ সালে গড়ে সপ্তাহে ৪২.৯ ঘণ্টা কাজ করেছেন — ২০১৯ সালের ৪৪.১ ঘণ্টা থেকে কম।
৩৫ বছরের নিচের কর্মীরাই এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন; তাঁদের কাজের সময় সপ্তাহে গড়ে দুই ঘণ্টা কমেছে।

ড্যামারিয়ান বেন্টনের অভিজ্ঞতা
শিকাগোর একটি জনসংযোগ সংস্থায় ইন্টার্নশিপের সময় বেন্টন ভোর সাতটা থেকে রাত অবধি কাজ করতেন, এমনকি অসুস্থ থাকলেও ছুটি নিতেন না।
তিনি বলেন, “আমি ভেবেছিলাম কঠোর পরিশ্রমই প্রমাণ করবে আমি যোগ্য।”
কিন্তু এক রাতে অতিরিক্ত চাপের কারণে তিনি ভেঙে পড়েন ও কাঁদতে শুরু করেন।
তাঁর ম্যানেজার তখনই বলেন, কিছু সময় বিরতি নাও — ডেডলাইন বাড়ানো যাবে।
এখন লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত বেন্টন সম্পূর্ণ বদলে গেছেন।
তিনি বলেন, “পাঁচটার পর আমি ল্যাপটপের কাছে না থাকলে, কেউ কারণ জানতে চায় না, আমিও ব্যাখ্যা দিই না।”
ছুটি নেওয়ার সময়ও তিনি দ্বিধা করেন না — আগের মতো আর নিজেকে ‘প্রমাণ’ করার প্রয়োজন বোধ করেন না।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বুঝতে পেরেছে — চাকরির প্রতি অন্ধ আনুগত্য আর সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়।
তাদের কাছে জীবনের মূল্য মানে হচ্ছে মানসিক শান্তি, ব্যক্তিগত সময় এবং নিজের নিয়ন্ত্রণে জীবন যাপন।
যতই ছাঁটাই বাড়ুক বা বাজার অনিশ্চিত হোক, জেনারেশন জেড একটাই বার্তা দিচ্ছে —
“আমরা কাজ করব, কিন্তু নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ রাখব নিজেদের হাতেই।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















