বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গণসংযোগের সময় গুলির ঘটনায় আহত হলেও তিনি মূল টার্গেট ছিলেন না বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
সে ঘটনায় যে ব্যক্তি নিহত হয়েছেন তিনিই আসলে মূল টার্গেট ছিলেন- বলা হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
নিহত সরোয়ার হোসেন বাবলা সন্ত্রাসী ছিলেন বলে পুলিশ দাবি করে বলছে, ‘ভাড়াটে খুনি’ এনে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে।
“যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের ক্যাডার না, যখন যেখানে সুবিধা সেদিকে কাজ করে। এদের ভেতরে কিছু হায়ারড কিলার (ভাড়াটে খুনি) আছে বলে আমাদের সন্দেহ। দেশের বাইরেও এদের লোকজন আছে,” বিবিসিকে বলছিলেন চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ।
এদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
তবে ঘটনার সঙ্গে বিএনপির এই দাবির কোনো সম্পর্ক দেখছে না পুলিশ।
নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তাদের দলের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করছেন বিএনপি নেতারা। বরং, সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তাক করে তারা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র বিরোধী কোনো অভিযান না চালানোয় এ ধরনের গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রামের ঘটনার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে বিবৃতি হামলাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামে আসলে কী ঘটেছে সেটা এখনো বোঝা না গেলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্যাডার রাখাটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা এবং এখনো এই সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
বরং বিএনপিকে ঘিরে যেসব ঘটনা সামনে আসছে সেগুলো তাদের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে বলে মনে করছেন তারা।
কী ঘটেছিল?
ঘটনাটির সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে যেখানে জনসংযোগ চলার মাঝে হঠাৎ একজনের পেছনে ঘাড়ের কাছে পিস্তল দিয়ে গুলি চালাতে দেখা যায়। যদিও কে গুলি চালিয়েছে সেটা সেই সেলফি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে আসেনি।
যিনি ভিডিও করছিলেন তিনি বন্দুকধারীর ধাক্কায় কিছুটা এগিয়ে যান বলেও মনে হচ্ছে।
বুধবার চট্টগ্রাম শহরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া এলাকায় একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষে নির্বাচনী প্রচারণার সময় গুলির এই ঘটনা ঘটে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে জানান, ঘাতকদের একজনকে তিনি মসজিদেই দেখেছেন।
এই ঘটনায় যিনি নিহত হয়েছেন, সেই সরোয়ার বাবলার বাবা আবদুল কাদের বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধী পক্ষ তাকে ফোনে হুমকি দিয়ে আসছিলো।
তবে ঘটনাটি “গ্যাং ফাইটের অংশ হতে পারে” বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। এর পেছনে চাঁদাবাজি এবং দখলদারি মূল মোটিফ বলেও তাদের ধারণা।
“বিএনপির প্রার্থী টার্গেট ছিলেন না। যে মারা গেছে সেও টপ টেরর ছিল, দশ বছর জেল খেটেছে, তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ ১০-১৫ টা মামলা ছিল” বিবিসিকে বলছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ।
সেখানে জনসংযোগ সম্পর্কে থানায় কোনো তথ্য না থাকায় সেখানে পুলিশের উপস্থিতিও ছিল না বলে জানান তিনি।
এখনো তথ্য সংগ্রহ চলছে এবং বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা বা গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানাচ্ছেন তিনি।

ক্যাডার যখন সমস্যা
বুধবারের এই ঘটনায় নিহত সরোয়ার হোসেন বাবলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছে বিএনপি, তবে তার সাথে বিএনপি নেতাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানা যাচ্ছে স্থানীয়ভাবে।
সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবিতে সরোয়ার বাবলার একটি বিলবোর্ডের মতো পোস্টার দেখা যায় যেখানে স্থানীয় বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর কারামুক্তিতে ‘শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’ জানানো হয়েছে।
মাসখানেক আগে মি. বাবলার বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপির কয়েকজন নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
এ নিয়ে অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বর্তমানে চট্টগ্রাম-১০ আসনের জন্য মনোনীত প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ব্যক্তিগত সম্পর্ক কার কী আছে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপিতে তার কোনো মেম্বারশিপ নাই, সে কোনো পদেও নাই। ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক তো অনেকের অনেকের সাথে আছে, এর সাথে বিএনপির রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই”।
কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে যেখানে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
২০২৪ এর ৫ই অগাস্ট পরবর্তী বাস্তবতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সহিংসতারও অনেক ঘটনা সামনে এসেছে, এমন অনেক ক্ষেত্রে বিএনপির দিক থেকে বহিষ্কার করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
রাজনীতিতে প্রভাব ও আধিপত্য ধরে রাখতে অস্ত্রধারী বা অপরাধীদের হাতের নাগালে রাখার প্রবণতা যেমন দেখা যায়, অপরাধীদের জন্যও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকাটা তাদের সুরক্ষার কাজে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্যাডার রাখাটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা এবং সব দলই কমবেশি ক্যাডার রাখে–– বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ। বিএনপির যেসব ঘটনা সামনে আসছে সেগুলো বিএনপির ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।
“এই ক্যাডার রাজনীতি যদি তারা দমন না করে তাহলে তাহলে সামনে নির্বাচনে বড় ধরনের বিপর্যয় দলেরও হতে পারে, জাতীয় পর্যায়ে ভোটারদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে” বলছেন তিনি।
নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতার মতো এমন ঘটনা যে সামনে আরও দেখা যাবে না বা অপরাধীরাও সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে না, এমনটাও বলা যায় না মনে করেন মি. আহমেদ।

কিন্তু ক্যাডার রাখার প্রয়োজন হয় কেন?
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন, “রাজনৈতিক দলগুলো ক্যাডার রাখতে চায়- প্রথমত যদি তাদের প্রতিপক্ষ ক্যাডার রাখে। আবার স্থানীয় রাজনীতিতে কোনো রাজনীতিবিদ নিজের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের তারা পালে। জাতীয় রাজনীতিতেও ইনডিরেক্টলি এটাকে অ্যালাও করে, কারণ বিপদের সময় যেহেতু এটা কাজে লাগে”।
আগে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও এমন নজির দেখা গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে ২০০১ সালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ঢাকার রাস্তায় একের পর এক ওয়ার্ড কমিশনারকে গুলি করে হত্যা- সেসবের প্রেক্ষিতে অভিযোগ এসেছিল যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া ওয়ার্ড কমিশনারদের অনেকেই ছিল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ২০০২ সালে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে একযোগে সেনাবাহিনী অভিযান চালায় যেটি ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচিত।
তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম দিনের অভিযানে প্রায় ১৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিএনপি নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন গ্রেফতারের তালিকায়।
সেসময় ঢালাও গ্রেফতার, বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, সমালোচনার প্রেক্ষিতে ৮৪ দিন অভিযানের পর সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়।
বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা তৈরি হলে অনেকের ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যু বলেও দাবি করা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে।
অপারেশন ক্লিনহার্ট শেষ করে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পর পালিয়ে থাকা অপরাধীরা আবারো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা যায়, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় অপরাধীরা আনন্দ-উল্লাসও করেছে।
২০০৩ সালে সে অপারেশন শেষ হওয়ার পর বড় বড় অভিযান পরিচালনা করার জন্য আলাদা বাহিনী গঠনের চিন্তা থেকে প্রাথমিকভাবে র্যাপিড অ্যাকশন টিম বা র্যাট গঠনের পরিকল্পনা হয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব।

বিএনপি কী বলছে?
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিক থেকে চট্টগ্রামের ঘটনা প্রসঙ্গে সরকারের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিবিসি বাংলাকে বলেন “এই সরকার আসার পর থেকে কোনো অবৈধ অস্ত্র ধরার জন্য কোনো ড্রাইভ দেয়নি। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য কোনো কিছুই করে নাই। ক্রিমিনাল, যারা ক্রাইম করে, দে শুড বি অন রান (তাদের দৌড়ের ওপর থাকা উচিত)। নির্বাচনের সময়ে যদি সরকার তাদেরকে অন রান না রাখে তাহলে তো অসুবিধা হবেই”।
২০১৪ সাল নাগাদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পর থেকে অস্ত্রের পরিধি বেড়েছে অভিযোগ করে তিনি বলছেন সরকারকে আরও সতর্ক হওয়া দরকার।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে গণসংযোগে গুলির ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুস্কৃতিকারিরা আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে”।
চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি’র মনোনয়নপ্রাপ্ত এরশাদ উল্লাহসহ আরও একাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধের ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে তিনি বলছেন “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাই এসব দুস্কৃতিকারিদের কঠোর হস্তে দমনের বিকল্প নেই”।
চট্টগ্রামের এই ঘটনা ঘিরে এখন পর্যন্ত নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলেও সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিগত এক বছরের মতোই চলতে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক পর্যায়ে এর কোনো না কোনো প্রভাব পড়তেই থাকবে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















