সূচকের পতন ও বাজারের অস্থিরতা
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে গত ১৩ নভেম্বর যখন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের পাশাপাশি বলছিলেন দেশের অর্থ–বাণিজ্যের ইতিবাচক কথা, তখন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে চলছিল সূচকের উত্থান–পতন।
দিন শেষে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে অবশেষে ডিএসইএক্স নেমে গেল ৪ হাজার ৭০২ পয়েন্টে। ১২৩ পয়েন্টের পতনে পুঁজিবাজারের এই ধস দেশের অর্থনীতির কিসের আভাস?
শেষ ছয় মাসে এটা দ্বিতীয়বারের মতো বড় দরপতন। কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ এই দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক কমে ৪ হাজার ৭০২ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
প্রায় পাঁচ মাসের ব্যবধানে এটি ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ী, এর আগে চলতি বছরের ২৩ জুন ডিএসইএক্স সূচকটি ৪ হাজার ৬৯৫ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ ও অর্থনৈতিক বার্তা
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতিকে গভীর গহ্বর থেকে উদ্ধার করা ছিল আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। গত ১৫ মাসে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে সক্ষম হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রিজার্ভসহ অর্থনীতির সব সূচকে দেশ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করতে নানা পদক্ষেপ চলছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী প্রথম বছরে এফডিআই ১৯.১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।’
ব্যাংক খাতের সংকট ও বাজারের আস্থাহীনতা
পাঁচ ব্যাংকের অস্থিরতা, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নানান জল্পনা–কল্পনা, রাজপথে ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের বিক্ষোভ, চাষীর আলুর দাম থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির তেমন কোনো উল্লেখ ছিল না সেই ভাষণে।
এখানে অবশ্য শুধু তুলে ধরবো শেয়ারবাজারের কথাই—যেখানে টাকা হয়ে যাচ্ছে তেজপাতা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এখন ১০ টাকার ফেসভ্যালুর দাম নেমেছে এক টাকারও নিচে।
রাজনৈতিক উত্তাপের দিনে বাজারের ধস
গত ১৩ নভেম্বর রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার জন্য নির্ধারিত ছিল।
তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী “লকডাউন” ডেকেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ। তার আগে কয়েকদিন দেশজুড়ে বাস–রেলে অগ্নিসংযোগের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক–মহাসড়ক এবং রাজধানীসহ নগর–মহানগরগুলোতে জনসমাগম ছিল খুব কম। বিকাল সাড়ে তিনটায় ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
তার আগেই ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে যায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক।
সূচকের ওঠানামা
সকাল থেকেই ছিল সূচকের ওঠানামা।
কার্যদিবসের প্রথম দুই ঘণ্টায় সূচক কমে যায় ৬৮ পয়েন্ট। দুপুর ১টা ১০ মিনিটে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৮ পয়েন্টে।
আধা ঘণ্টা পর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় ১০৯ পয়েন্টে। কিন্তু দিনশেষে এই পতন স্থির হয় ১২২ পয়েন্টে।
ঐদিন প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ভাষণে সংস্কার নিয়ে আদেশ জারির আভাস দেওয়ার পর প্রকাশিত হয়েছিল এর গেজেট, যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি।
রাজনৈতিক স্থিতি ও বাজার পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন
রাজনীতিতে স্বস্তি এসেছে সেই ভাষণে বা দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেল নির্বাচনের দিকে—তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
কিন্তু ভোটের আগে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে তেমন কোনো আভাস দিতে রাজি নন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বা ব্রোকার হাউজের কেউ।
কারণ খুঁজতে গলদঘর্ম হচ্ছেন ব্রোকার হাউজ এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মার্জিন লোন নীতি ও পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার শূন্য ঘোষণা
তবে অনেকেই শেয়ারবাজারের ধসের পেছনে মার্জিন ঋণের নতুন নীতিমালা এবং পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন বন্ধ হওয়াকে দায়ী করছেন।
তথ্য বলছে—এক্সিম ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটিজ, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের পরিমাণ ৫৮১ কোটি ৯৫ লাখ।
১০ টাকা ফেসভ্যালুর হিসেবে এর দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। যদিও এগুলোর সবগুলোর দামই নেমেছিল ৫ টাকার নিচে। পাঁচটি ব্যাংকই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ছিল।
শেয়ার শূন্য ঘোষণার বিতর্ক
কিন্তু যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে এসব শেয়ারের দাম এখন শূন্য।
ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় শেয়ারের মূল্য “শূন্য” ঘোষণা করা হয়েছে।
ব্যাংকের উদ্যোক্তা–পরিচালকদের কেউ কেউ এসব ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবার জন্য দায়ী, কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে যারা শেয়ার কিনেছিল এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এসব ব্যাংক থেকে লভ্যাংশও পেয়েছিল তাদের কি দোষ?
আর কি কারণেই বা তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না—তার ব্যাখ্যা না বাংলাদেশ ব্যাংক, না সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন কেউ দিচ্ছে না।
মূল প্রশ্ন: টাকা কি তেজপাতা হয়ে গেলো?
আর কি কারণেই মাত্র মাস খানেক আগেও এক্সিম ব্যাংকের ৪ টাকার শেয়ারের দাম শতকরা ১০ শতাংশ বেড়ে ৪.৪০ টাকায় বিক্রি হয়ে ঢাকা স্টকের টপ টেনে জায়গা করে নিয়েছিল—তার কারণ খোঁজারও যেন কেউ নেই।
তাই তো প্রশ্ন উঠেছে—এসব শেয়ার কেনার টাকা কি সত্যিই তেজপাতা হয়ে গেল? শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
সারাক্ষণ বিশ্লেষণ 


























