০২:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

ঘন ঘন ভূমিকম্প: বড় ধাক্কার জন্য ঢাকা কি প্রস্তুত?

মাত্র দু’দিনে ঢাকায় কয়েক দফা ভূমিকম্প রাজধানীতে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ঘনবসতি, পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও বিল্ডিং কোড না মানায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অল্পমাত্রার কম্পনেও বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে আছে ঢাকা।


কেন্দ্রীয় বাংলাদেশসহ জনবহুল ঢাকা দু’দিনে কয়েক দফা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতি আর অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণের কারণে রাজধানী বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।

জনবসতিপূর্ণ ঢাকা, বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি, টানা কয়েকটি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পুরোনো ভবন যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি—যা রাজধানীকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।


শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প: আতঙ্কের সূচনা

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প রাজধানীর ছুটির দিনের শান্তি ভেঙে আতঙ্ক ছড়ায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এই কম্পনের কেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জের মাধবদী এলাকায়, মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত এই কম্পনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে—ঢাকায় ৪ জন, নরসিংদীতে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ১ জন। আহত হয়েছেন ৬০০-র বেশি মানুষ।

১৯৯৯ সালের মহেশখালীর ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশে এত প্রাণহানি আর হয়নি।

তবে এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। কেন্দ্রস্থল রাজধানীর এত কাছে হওয়ায় প্রায় এক কোটি মানুষ ‘তীব্র কম্পন’ অনুভব করেছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানায়।


টানা আফটারশক: অস্থিরতার নতুন স্তর

শুক্রবারের ভূমিকম্পের ২৪ ঘণ্টার মাথায় শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে নরসিংদীর পলাশে ৩.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। এর ৮ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৬টা ০৬ মিনিটে একই এলাকায় ৪.৩ মাত্রার আরেকটি কম্পন ঢাকাসহ আশপাশে অনুভূত হয়।

কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও পরপর তিন দফা কম্পন ভূগর্ভস্থ ফল্টলাইনের সক্রিয়তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।


ঢাকায় ভবন ক্ষতি ও মানুষের মানসিক বিপর্যয়

শুক্রবারের কম্পনে ঢাকার অন্তত ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানায়। রাজউক বলছে—৫টির বেশি ভবন হেলে পড়েছে এবং ৫০টির বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

অনেকের জন্য এখনো মানসিক চাপ কাটেনি। বহু মানুষ অনুভব করছেন—মাটি আর আগের মতো দৃঢ় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জানান, “মুজিব হলে থাকি। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর সামান্য শব্দেও মনে হয় আবার ভূমিকম্প হচ্ছে। ভয় চলে যাচ্ছে না।”

আতঙ্কে লাফিয়ে নামার সময় গুরুতর আহত হয়েছেন ঢাবির চারজন শিক্ষার্থী। পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করেছে।


ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন: পরিস্থিতির ভয়াবহতা

রাজউকের তথ্য:

  • ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি
  • ২০১৬ সালে হালনাগাদ
  • বর্তমানে ৩২১টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
  • ২০২৪ সালে আরও ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে চিহ্নিত

২০১৮–২০২২ সালের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের জরিপে দেখা গেছে—যদি মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ঢাকার প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে দিনের বেলায় ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ১০ হাজার এবং আহত হতে পারে ২ লাখ ২৯ হাজার মানুষ।


বিল্ডিং কোড অবহেলার মূল্য

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (IPD) জানায়—ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বিল্ডিং কোড, মাস্টারপ্ল্যান ও ভূমি ব্যবহার নীতিমালা অমান্য করার প্রবণতা ব্যাপক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের সতর্ক হওয়ার শেষ সুযোগ।

এদিকে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স অভিযোগ করেছে—ডিএপি সংশোধনের উপদেষ্টা পরিষদে রিয়েল এস্টেট স্বার্থ জড়িত, যা উচ্চ ভবন নির্মাণকে উৎসাহিত করছে।


নতুন নির্মাণ প্রযুক্তি: ‘বেজ আইসোলেশন’

২০১১ সালে জাপানে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পে—যেসব ভবনে ‘বেজ আইসোলেশন’ প্রযুক্তি ছিল, সেখানে একটি কাচও ভাঙেনি।

বেজ আইসোলেশন কী?

  • ভবনকে সরাসরি মাটির সাথে আটকে না রেখে
  • নিচে শত শত রাবার-সীসা বিয়ারিং বসানো হয়
  • ভূমিকম্পে মাটি তীব্র কাঁপলেও ভবন ধীরে দুলে নিরাপদ থাকে

জাপানে এখন অধিকাংশ নতুন ভবন, হাসপাতাল, স্কুল ও ডেটা সেন্টারে এই প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক। পুরনো ভবন কাটার পরও বেজ আইসোলেশন বসিয়ে নিরাপদ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশেও BNBC-2020 অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বেজ আইসোলেশন ব্যবহার শুরু হয়েছে।

  • রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র
  • মেট্রোরেল স্টেশন
  • কয়েকটি নতুন টাওয়ার
    —এগুলোতে প্রযুক্তিটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে—যমুনা ও পদ্মা সেতুতে উন্নত সিসমিক বিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।

প্রথমবারের মতো ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের নতুন ভবনে বেজ আইসোলেশন প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।


দেশের ভূমিকম্প–ঝুঁকির অঞ্চল

বাংলাদেশকে তিনটি সিসমিক জোনে ভাগ করা হয়েছে:

  • জোন-১: সর্বোচ্চ ঝুঁকি
  • জোন-২: মাঝারি ঝুঁকি
  • জোন-৩: অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি

উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা:

  • সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৯ জেলা
  • টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর অংশ
  • পুরো কিশোরগঞ্জ
  • কুমিল্লা বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  • পার্বত্য খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বৃহৎ অংশ


ইতিহাস জানাচ্ছে সতর্কবার্তা

১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে—বেশিরভাগই সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে। এসব এলাকায় ভবিষ্যতেও বড় ভূমিকম্প হতে পারে বলে ধারণা।

ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ ও ঘনবসতি এখন সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।


রাজউক ও পরিবেশ উপদেষ্টার সতর্কবার্তা

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিদর্শনে রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম বলেন—“এটি আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত। গুরুত্ব না দিলে বড় বিপর্যয় আসবে।”

তিনি জানান—ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিপজ্জনক স্থাপনা অপসারণ চলছে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সায়েদা রিজওয়ানা হাসান বলেন—ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পুরনো ভবন কোড মানেনি, ফলে রাজধানী ভীষণ ঝুঁকিতে।
তিনি বলেন, “এত শক্ত ভূমিকম্প আমরা কখনো অনুভব করিনি। এটি আমাদের জাগিয়ে তোলার সময়।”


ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি, দুর্বল ভবন, ঘনবসতি ও কোড না মানা—সব মিলিয়ে ঢাকা ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এখনই প্রস্তুতি না নিলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।


#

#ঢাকা_ভূমিকম্প
#ভবন_ঝুঁকি
#আফটারশক
#রাজউক
#বেজ_আইসোলেশন

জনপ্রিয় সংবাদ

ঘন ঘন ভূমিকম্প: বড় ধাক্কার জন্য ঢাকা কি প্রস্তুত?

১২:০৮:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

মাত্র দু’দিনে ঢাকায় কয়েক দফা ভূমিকম্প রাজধানীতে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ঘনবসতি, পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও বিল্ডিং কোড না মানায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অল্পমাত্রার কম্পনেও বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে আছে ঢাকা।


কেন্দ্রীয় বাংলাদেশসহ জনবহুল ঢাকা দু’দিনে কয়েক দফা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতি আর অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণের কারণে রাজধানী বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।

জনবসতিপূর্ণ ঢাকা, বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটি, টানা কয়েকটি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পুরোনো ভবন যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি—যা রাজধানীকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।


শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প: আতঙ্কের সূচনা

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প রাজধানীর ছুটির দিনের শান্তি ভেঙে আতঙ্ক ছড়ায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এই কম্পনের কেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জের মাধবদী এলাকায়, মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত এই কম্পনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে—ঢাকায় ৪ জন, নরসিংদীতে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ১ জন। আহত হয়েছেন ৬০০-র বেশি মানুষ।

১৯৯৯ সালের মহেশখালীর ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশে এত প্রাণহানি আর হয়নি।

তবে এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। কেন্দ্রস্থল রাজধানীর এত কাছে হওয়ায় প্রায় এক কোটি মানুষ ‘তীব্র কম্পন’ অনুভব করেছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানায়।


টানা আফটারশক: অস্থিরতার নতুন স্তর

শুক্রবারের ভূমিকম্পের ২৪ ঘণ্টার মাথায় শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে নরসিংদীর পলাশে ৩.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। এর ৮ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৬টা ০৬ মিনিটে একই এলাকায় ৪.৩ মাত্রার আরেকটি কম্পন ঢাকাসহ আশপাশে অনুভূত হয়।

কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও পরপর তিন দফা কম্পন ভূগর্ভস্থ ফল্টলাইনের সক্রিয়তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।


ঢাকায় ভবন ক্ষতি ও মানুষের মানসিক বিপর্যয়

শুক্রবারের কম্পনে ঢাকার অন্তত ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানায়। রাজউক বলছে—৫টির বেশি ভবন হেলে পড়েছে এবং ৫০টির বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

অনেকের জন্য এখনো মানসিক চাপ কাটেনি। বহু মানুষ অনুভব করছেন—মাটি আর আগের মতো দৃঢ় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জানান, “মুজিব হলে থাকি। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর সামান্য শব্দেও মনে হয় আবার ভূমিকম্প হচ্ছে। ভয় চলে যাচ্ছে না।”

আতঙ্কে লাফিয়ে নামার সময় গুরুতর আহত হয়েছেন ঢাবির চারজন শিক্ষার্থী। পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করেছে।


ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন: পরিস্থিতির ভয়াবহতা

রাজউকের তথ্য:

  • ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি
  • ২০১৬ সালে হালনাগাদ
  • বর্তমানে ৩২১টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
  • ২০২৪ সালে আরও ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে চিহ্নিত

২০১৮–২০২২ সালের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের জরিপে দেখা গেছে—যদি মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ঢাকার প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে দিনের বেলায় ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ১০ হাজার এবং আহত হতে পারে ২ লাখ ২৯ হাজার মানুষ।


বিল্ডিং কোড অবহেলার মূল্য

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (IPD) জানায়—ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বিল্ডিং কোড, মাস্টারপ্ল্যান ও ভূমি ব্যবহার নীতিমালা অমান্য করার প্রবণতা ব্যাপক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের সতর্ক হওয়ার শেষ সুযোগ।

এদিকে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স অভিযোগ করেছে—ডিএপি সংশোধনের উপদেষ্টা পরিষদে রিয়েল এস্টেট স্বার্থ জড়িত, যা উচ্চ ভবন নির্মাণকে উৎসাহিত করছে।


নতুন নির্মাণ প্রযুক্তি: ‘বেজ আইসোলেশন’

২০১১ সালে জাপানে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পে—যেসব ভবনে ‘বেজ আইসোলেশন’ প্রযুক্তি ছিল, সেখানে একটি কাচও ভাঙেনি।

বেজ আইসোলেশন কী?

  • ভবনকে সরাসরি মাটির সাথে আটকে না রেখে
  • নিচে শত শত রাবার-সীসা বিয়ারিং বসানো হয়
  • ভূমিকম্পে মাটি তীব্র কাঁপলেও ভবন ধীরে দুলে নিরাপদ থাকে

জাপানে এখন অধিকাংশ নতুন ভবন, হাসপাতাল, স্কুল ও ডেটা সেন্টারে এই প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক। পুরনো ভবন কাটার পরও বেজ আইসোলেশন বসিয়ে নিরাপদ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশেও BNBC-2020 অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বেজ আইসোলেশন ব্যবহার শুরু হয়েছে।

  • রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র
  • মেট্রোরেল স্টেশন
  • কয়েকটি নতুন টাওয়ার
    —এগুলোতে প্রযুক্তিটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে—যমুনা ও পদ্মা সেতুতে উন্নত সিসমিক বিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।

প্রথমবারের মতো ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের নতুন ভবনে বেজ আইসোলেশন প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।


দেশের ভূমিকম্প–ঝুঁকির অঞ্চল

বাংলাদেশকে তিনটি সিসমিক জোনে ভাগ করা হয়েছে:

  • জোন-১: সর্বোচ্চ ঝুঁকি
  • জোন-২: মাঝারি ঝুঁকি
  • জোন-৩: অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি

উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা:

  • সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৯ জেলা
  • টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর অংশ
  • পুরো কিশোরগঞ্জ
  • কুমিল্লা বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  • পার্বত্য খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বৃহৎ অংশ


ইতিহাস জানাচ্ছে সতর্কবার্তা

১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে—বেশিরভাগই সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে। এসব এলাকায় ভবিষ্যতেও বড় ভূমিকম্প হতে পারে বলে ধারণা।

ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ ও ঘনবসতি এখন সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।


রাজউক ও পরিবেশ উপদেষ্টার সতর্কবার্তা

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিদর্শনে রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম বলেন—“এটি আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত। গুরুত্ব না দিলে বড় বিপর্যয় আসবে।”

তিনি জানান—ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিপজ্জনক স্থাপনা অপসারণ চলছে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সায়েদা রিজওয়ানা হাসান বলেন—ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পুরনো ভবন কোড মানেনি, ফলে রাজধানী ভীষণ ঝুঁকিতে।
তিনি বলেন, “এত শক্ত ভূমিকম্প আমরা কখনো অনুভব করিনি। এটি আমাদের জাগিয়ে তোলার সময়।”


ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি, দুর্বল ভবন, ঘনবসতি ও কোড না মানা—সব মিলিয়ে ঢাকা ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এখনই প্রস্তুতি না নিলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।


#

#ঢাকা_ভূমিকম্প
#ভবন_ঝুঁকি
#আফটারশক
#রাজউক
#বেজ_আইসোলেশন