প্রাচীন শিলায় জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। শুধু জৈব অণু পাওয়া মানেই জীববৈজ্ঞানিক উৎস রয়েছে—এমন নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের শিলায় জৈব অণু থাকে, কারণ ‘জৈব’ শব্দটি কেবল কার্বন-পরমাণুর শৃঙ্খলযুক্ত অণুকে বোঝায়। এমনকি কিছু উল্কাপিণ্ডেও প্রচুর জৈব অণু পাওয়া যায়, যেগুলোর পেছনে কোনো জীববৈজ্ঞানিক উৎস নেই। শিল্প ল্যাবরেটরিতেও নিয়মিত তৈরি হয় এমন অণু, যা প্রকৃতিতে কখনোই ছিল না।
বিশেষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো অণুর কার্বন-গঠন জীববৈজ্ঞানিক উৎস নির্দেশ করে কি না, তা কখনো কখনো শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এই পদ্ধতি ১.৬ বিলিয়ন বছরের বেশি পুরোনো নমুনায় কখনো কাজ করেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা মূলত দুটি বিষয়ে নজর দেন—নমুনায় উপস্থিত কার্বনের আইসোটোপের অনুপাত (কারণ জীবিত প্রাণ সাধারণত হালকা আইসোটোপ বেশি ব্যবহার করে) এবং শিলায় মাইক্রোব সদৃশ গঠন আছে কি না। তবে এ দুটো পদ্ধতিই সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়।
প্রাচীন জীবনের চিহ্ন শনাক্তে মেশিন লার্নিং
এই সমস্যার নতুন সমাধান হিসেবে সম্প্রতি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস–এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার দেখা গেছে। এই পদ্ধতি শুধু পৃথিবীর প্রাচীন নমুনা নয়, মঙ্গলসহ অন্য গ্রহের নমুনাতেও জীবন অনুসন্ধানে সহায়তা করতে পারে।
এখানে শিলার প্রতিটি অণু আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করার বদলে নমুনাকে টুকরো করে ভেঙে তার ভর ও প্রাবল্যের তথ্য একটি দ্বিমাত্রিক গ্রিডে দেখানো হয়। ফলাফল দেখতে অনেকটা পাহাড়ি ভূদৃশ্যের মতো—বিভিন্ন উচ্চতার চূড়ার সমাহার। প্রতিটি নমুনার এই ‘ভূদৃশ্য’ আলাদা, তবে কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ বৈশিষ্ট্যও পাওয়া যায়।
গবেষণা: জীববৈজ্ঞানিক উৎস শনাক্তে চারটি মডেল
মাইকেল ওং (অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্ট) ও অনিরুদ্ধ প্রভু (মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ)—দু’জনই কার্নেগি সায়েন্সের গবেষক—নেতৃত্বাধীন এই দলে জীবিত প্রাণী, জীবাশ্ম, উল্কাপিণ্ড ও শিল্প প্রক্রিয়া থেকে সংগৃহীত নমুনার ‘ভূদৃশ্য’ ব্যবহার করা হয়। তারা এমন চারটি মডেল তৈরি করেন, যা জীববৈজ্ঞানিক উৎসযুক্ত নমুনা ও অজৈব উৎসের নমুনাকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে।
মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তারা যে সবচেয়ে পুরোনো নমুনাটিকে জীববৈজ্ঞানিক হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, তার বয়স ৩.৩ বিলিয়ন বছর—যা পূর্বে প্রচলিত অণুভিত্তিক পদ্ধতিতে শনাক্ত নমুনার বয়সের দ্বিগুণ।

পরবর্তী ধাপ: আরও বৈচিত্র্যময় ডেটা
নাসা এখন এই গবেষণার সম্প্রসারণে অর্থায়ন করছে। পরবর্তী পর্যায়ে গবেষকেরা আরও বড় এবং বৈচিত্র্যময় ডেটাসেট তৈরি করবেন—যেখানে থাকবে অধিকসংখ্যক ছত্রাক, বেশি জীবাশ্ম নমুনা এবং উচ্চ তাপ ও চাপের প্রভাবে বদলে যাওয়া নমুনাসহ আরও অনেক কিছু। এতে মডেলের নির্ভুলতা বাড়বে এবং ভবিষ্যতে এটি বহির্গ্রহীয় নমুনা বিশ্লেষণে ব্যবহার করা যাবে।
মঙ্গলে আটকে থাকা মূল্যবান নমুনা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নমুনাগুলোর বেশিরভাগই এখন মঙ্গলে। নাসার পারসিভিয়ারেন্স রোভার যে জৈব উপাদান সংগ্রহ করেছে, সেগুলো এখনো মঙ্গলের মাটিতেই পড়ে আছে—কারণ এগুলো পৃথিবীতে আনার মতো বাজেট বা প্রযুক্তি বর্তমানে নাসার নেই।
তবে আগামী অভিযানে নতুন এই বিশ্লেষণ ব্যবস্থা সঙ্গে নেওয়া গেলে সেখানেই নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। শনির উপগ্রহ এনসেলাডাসের গেইজারগুলোর জৈব উপাদানও ভবিষ্যৎ অভিযানের আকর্ষণীয় লক্ষ্য হতে পারে।
জীবনের মূল ফাংশন কি চিহ্ন রাখে?
এই গবেষণার আরেকটি সম্ভাবনা হলো—জীবিত বস্তু বা তাদের উপাদানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘কার্যকারিতা’। দলের কয়েকজন বিজ্ঞানী, যার মধ্যে ড. ওং রয়েছেন, মনে করেন যে জীবনের অস্তিত্ব নির্দেশক ভূদৃশ্যগুলো হয়তো কোনো বিশেষ কার্যকরী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা কেবল আকস্মিকভাবে গঠিত অণুগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় না।
যদি সত্যিই এমন হয়, তবে এই পদ্ধতি শুধু জীবন খুঁজেই দেবে না—বরং জীবনের বিশেষত্ব কী, সে বিষয়েও নতুন ধারণা দিতে পারে।
#বিজ্ঞান মহাকাশ #গবেষণা #মঙ্গল #নাসা #জীবাশ্ম #অ্যাস্ট্রোবায়োলজি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















