যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিসহ বিপুলসংখ্যক মুসলিম নাগরিকের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আইনি ক্ষমতার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিকে মানবাধিকার ও সমতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছেন অধিকারকর্মীরা।
গবেষণা প্রতিবেদনের মূল সতর্কতা
গত ১১ ডিসেম্বর রানিমেড ট্রাস্ট ও রিপ্রিভ প্রকাশিত এক যৌথ গবেষণায় জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের প্রায় নব্বই লাখ মানুষ নাগরিকত্ব বাতিলের আইনি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় তেরো শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান আইন অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনো ব্রিটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারেন।
কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
অধিকারকর্মীদের মতে, এই ক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে পারিবারিক বা বংশগত সম্পর্ক রয়েছে এমন নাগরিকদের ওপর অসমভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এসব অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তারাই প্রধানত এই আশঙ্কার মুখে পড়ছেন।
আইনের বিতর্কিত দিক
বর্তমান আইনে বলা আছে, যদি সরকার মনে করে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য, তবে তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে। এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনো সেই দেশে বসবাস না করলেও বা নিজেকে সেই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় না দিলেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে। এর ফলে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে এক ধরনের বর্ণভিত্তিক বিভাজন তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বৈষম্যের অভিযোগ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিকরা সাধারণত এই ঝুঁকির মধ্যে পড়েন না। বিপরীতে অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের মধ্যে পাঁচজনের তিনজন নাগরিকত্ব হারানোর সম্ভাব্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র বিশ জনে একজন।
অধিকারকর্মীদের প্রতিক্রিয়া
রিপ্রিভের প্রতিনিধি মায়া ফোয়া জানান, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য অতীতে মানব পাচারের শিকার ব্রিটিশ নাগরিকদেরও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে, বর্তমান সরকার এই চরম ও গোপন ক্ষমতা আরও বিস্তৃত করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় এলে এই ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রানিমেড ট্রাস্টের পরিচালক শাবনা বেগমও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ও যথেচ্ছ ক্ষমতা ব্রিটেনের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
পরিসংখ্যান ও বাস্তব চিত্র
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় নয় লাখ চুরাশি হাজার, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ছয় লাখ ঊনআশি হাজার এবং বাংলাদেশিসহ মোট তেত্রিশ লাখ এশীয় ব্রিটিশ এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বাস্তবে যাদের নাগরিকত্ব ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মুসলিম।
গবেষণা প্রতিবেদনটি যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব, সমতা ও মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, এই আইন ও ক্ষমতার ব্যবহার অব্যাহত থাকলে দেশটিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















