১১:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
মরুভূমিতে হঠাৎ বন্যা: ওমানে প্রাণঘাতী বৃষ্টির নতুন বাস্তবতা চীনের বিনিয়োগে ঐতিহাসিক মোড়, তিন দশকের ধারাবাহিকতা ভাঙার মুখে অর্থনীতি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়ে সেভেন সিস্টার্স আলাদা করে দেব সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী মামলা প্রত্যাহারের দাবি সম্পাদক পরিষদের সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীর পাঁচ দিনের রিমান্ডে সমালোচনা করা যাবে না- এই বার্তাই কি দেওয়া হলো আনিস আলমগীরের ঘটনায় ড. ইউনূস চাইলে সারা দেশকে কারাগার বানাতে পারেন: আদালতে সাংবাদিক আনিস আলমগীর বাংলাদেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য নতুন নিরাপত্তা সতর্কতা জারি টানা পতনে আতঙ্ক: দ্বিতীয় দিনেও লাল পুঁজিবাজার, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে আগে গ্রেপ্তার, পরে মামলা: সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অভিযোগ

চিলির রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে অপরাধের ভয়

চিলির উত্তর-পূর্ব সীমান্তঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম কারিকিমায় এখন আর আগের মতো নিশ্চিন্ত সকাল নামে না। বলিভিয়া সীমান্তের কাছের এই পাহাড়ি জনপদে জীবনের বড় পরিবর্তনটা চোখে পড়ে দরজার তালা আর জানালার লোহার গ্রিলে। জীবনে প্রথমবার নিজের বাড়িতে তালা লাগিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা এরিকা মোসকোসো। দীর্ঘদিন নিরাপদ বলে পরিচিত চিলিতে অপরাধের ভয় এখন গ্রামের আঙিনা ছাড়িয়ে রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে পাটাগোনিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

এরিকা মোসকোসোর ভাষায়, আগে এমন ভয় কখনো ছিল না। আলপাকা চরা পাহাড়ি মালভূমি আর স্বচ্ছ জলধারার পাশে আদিবাসী কৃষকদের কাঁচা বাড়িগুলোতে এখন উঁচু অ্যালুমিনিয়ামের গেট আর জানালায় লোহার জাল। এই দৃশ্য শুধু একটি গ্রামের নয়, পুরো চিলির মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

অপরাধের ঢেউ এবং রাজনীতির বাঁক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হত্যা ও সহিংস অপরাধের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া চিলির রাজনীতিকে নতুন পথে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের দ্রুত বিস্তারের ফলে দীর্ঘদিন তুলনামূলক নিরাপদ দেশ হিসেবে পরিচিত চিলিতে নিরাপত্তাই হয়ে উঠেছে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ভয়ই ভোটারদের বড় অংশকে ডানপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তবে এই চিত্র শুধু চিলির নয়। পুরো লাতিন আমেরিকায় গত এক দশকে সংগঠিত অপরাধ বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। চিলি, কোস্টারিকা ও ইকুয়েডরের মতো শান্ত দেশগুলোও এখন সহিংসতার চাপে। একাধিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অন্তত আটটি দেশে ভোটারদের প্রধান উদ্বেগ নিরাপত্তা, যার ফলে কঠোর আইনশৃঙ্খলা নীতির প্রতি সহনশীলতা বাড়ছে।

বুকেলের ছায়া লাতিন রাজনীতিতে
এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে অপরাধ দমনে কড়া হাতে নামিয়ে অঞ্চলে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নাগরিক অধিকার সংকুচিত হলেও তার দেশের অপরাধের হার নাটকীয়ভাবে কমেছে। এই মডেল এখন কোস্টারিকা থেকে উরুগুয়ে পর্যন্ত বিভিন্ন নেতার আগ্রহ কেড়েছে।

চিলিতেও নিরাপত্তা ইস্যুতে ডানপন্থী প্রার্থী হোসে আন্তোনিও কাস্তের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তিনি সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ প্রবেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিবাসন ও অপরাধের বিরুদ্ধে তার কড়া অবস্থান অনেক ভোটারের কাছে আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সংখ্যায় আতঙ্কের বাস্তবতা
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চিলিতে দুই হাজার বাইশ সালে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার তিনশ বাইশে, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দুই হাজার চব্বিশ সালে তা কিছুটা কমলেও দুই হাজার আঠারোর তুলনায় এখনো অনেক বেশি। জরিপ বলছে, রাতে হাঁটতে নিরাপদ মনে করেন এমন মানুষের হার চল্লিশ শতাংশেরও কম।

উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু হওয়া সংকট
এই সংকটের শুরু চিলির উত্তরে। করোনা মহামারির সময় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়া ভেনেজুয়েলার হাজারো মানুষ আতাকামা মরুভূমি পেরিয়ে ইকিকু শহরে পৌঁছাতে শুরু করেন। মানবিক সংকটে নাকাল হয় স্থানীয় প্রশাসন। যদিও অভিবাসীদের খুব অল্প অংশ অপরাধে জড়িত, তবু তাদের সঙ্গে কিছু সংঘবদ্ধ চক্রও ঢুকে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইকিকুর মেয়র মাউরিসিও মাকিয়াভেলোর ভাষায়, শহরে এমন সহিংসতার ঘটনা ঘটতে শুরু করে যা আগে কখনো কল্পনাও করা যায়নি। গাড়ির ভেতর মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, মাথায় গুলি করে বেঁধে রাখা লাশ—এই দৃশ্য চিলির পরিচিত বাস্তবতার বাইরে।

ভয়, ভোট আর ভবিষ্যৎ
সরকার সীমান্তে সেনা মোতায়েন ও বিশেষ অপরাধ দমন ইউনিট গঠন করে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাও কমেছে। তবু মানুষের মনে জমে থাকা ভয় কাটেনি। ছোট গ্রাম কুয়েবে এক বৃদ্ধাকে নিজ বাড়িতে হত্যা করার ঘটনা সেই আতঙ্ককে আরও গভীর করেছে।

অনেক ভোটার এখন নিরাপত্তার বিনিময়ে সামাজিক অগ্রগতির কিছু অধিকার ছাড়তেও রাজি। ইকিকুর অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক মিরনা মাতকোভিচের কথায়, কিছু বিষয়ে পিছিয়ে যাওয়া পছন্দ না হলেও শৃঙ্খলা ফেরাতে শক্ত হাত দরকার।

চিলি এখনো লাতিন আমেরিকার তুলনায় নিরাপদ দেশগুলোর একটি। কিন্তু অপরাধের ভয় মানুষের মানসিকতা, রাজনীতি আর ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে গভীর ছাপ ফেলছে। এই ভয়ই বদলে দিচ্ছে চিলির রাজনৈতিক মানচিত্র।

জনপ্রিয় সংবাদ

মরুভূমিতে হঠাৎ বন্যা: ওমানে প্রাণঘাতী বৃষ্টির নতুন বাস্তবতা

চিলির রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে অপরাধের ভয়

০৬:৪১:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

চিলির উত্তর-পূর্ব সীমান্তঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম কারিকিমায় এখন আর আগের মতো নিশ্চিন্ত সকাল নামে না। বলিভিয়া সীমান্তের কাছের এই পাহাড়ি জনপদে জীবনের বড় পরিবর্তনটা চোখে পড়ে দরজার তালা আর জানালার লোহার গ্রিলে। জীবনে প্রথমবার নিজের বাড়িতে তালা লাগিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা এরিকা মোসকোসো। দীর্ঘদিন নিরাপদ বলে পরিচিত চিলিতে অপরাধের ভয় এখন গ্রামের আঙিনা ছাড়িয়ে রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে পাটাগোনিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

এরিকা মোসকোসোর ভাষায়, আগে এমন ভয় কখনো ছিল না। আলপাকা চরা পাহাড়ি মালভূমি আর স্বচ্ছ জলধারার পাশে আদিবাসী কৃষকদের কাঁচা বাড়িগুলোতে এখন উঁচু অ্যালুমিনিয়ামের গেট আর জানালায় লোহার জাল। এই দৃশ্য শুধু একটি গ্রামের নয়, পুরো চিলির মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

অপরাধের ঢেউ এবং রাজনীতির বাঁক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হত্যা ও সহিংস অপরাধের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া চিলির রাজনীতিকে নতুন পথে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের দ্রুত বিস্তারের ফলে দীর্ঘদিন তুলনামূলক নিরাপদ দেশ হিসেবে পরিচিত চিলিতে নিরাপত্তাই হয়ে উঠেছে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ভয়ই ভোটারদের বড় অংশকে ডানপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তবে এই চিত্র শুধু চিলির নয়। পুরো লাতিন আমেরিকায় গত এক দশকে সংগঠিত অপরাধ বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। চিলি, কোস্টারিকা ও ইকুয়েডরের মতো শান্ত দেশগুলোও এখন সহিংসতার চাপে। একাধিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অন্তত আটটি দেশে ভোটারদের প্রধান উদ্বেগ নিরাপত্তা, যার ফলে কঠোর আইনশৃঙ্খলা নীতির প্রতি সহনশীলতা বাড়ছে।

বুকেলের ছায়া লাতিন রাজনীতিতে
এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে অপরাধ দমনে কড়া হাতে নামিয়ে অঞ্চলে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নাগরিক অধিকার সংকুচিত হলেও তার দেশের অপরাধের হার নাটকীয়ভাবে কমেছে। এই মডেল এখন কোস্টারিকা থেকে উরুগুয়ে পর্যন্ত বিভিন্ন নেতার আগ্রহ কেড়েছে।

চিলিতেও নিরাপত্তা ইস্যুতে ডানপন্থী প্রার্থী হোসে আন্তোনিও কাস্তের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তিনি সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ প্রবেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিবাসন ও অপরাধের বিরুদ্ধে তার কড়া অবস্থান অনেক ভোটারের কাছে আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সংখ্যায় আতঙ্কের বাস্তবতা
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চিলিতে দুই হাজার বাইশ সালে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার তিনশ বাইশে, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দুই হাজার চব্বিশ সালে তা কিছুটা কমলেও দুই হাজার আঠারোর তুলনায় এখনো অনেক বেশি। জরিপ বলছে, রাতে হাঁটতে নিরাপদ মনে করেন এমন মানুষের হার চল্লিশ শতাংশেরও কম।

উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু হওয়া সংকট
এই সংকটের শুরু চিলির উত্তরে। করোনা মহামারির সময় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়া ভেনেজুয়েলার হাজারো মানুষ আতাকামা মরুভূমি পেরিয়ে ইকিকু শহরে পৌঁছাতে শুরু করেন। মানবিক সংকটে নাকাল হয় স্থানীয় প্রশাসন। যদিও অভিবাসীদের খুব অল্প অংশ অপরাধে জড়িত, তবু তাদের সঙ্গে কিছু সংঘবদ্ধ চক্রও ঢুকে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইকিকুর মেয়র মাউরিসিও মাকিয়াভেলোর ভাষায়, শহরে এমন সহিংসতার ঘটনা ঘটতে শুরু করে যা আগে কখনো কল্পনাও করা যায়নি। গাড়ির ভেতর মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, মাথায় গুলি করে বেঁধে রাখা লাশ—এই দৃশ্য চিলির পরিচিত বাস্তবতার বাইরে।

ভয়, ভোট আর ভবিষ্যৎ
সরকার সীমান্তে সেনা মোতায়েন ও বিশেষ অপরাধ দমন ইউনিট গঠন করে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাও কমেছে। তবু মানুষের মনে জমে থাকা ভয় কাটেনি। ছোট গ্রাম কুয়েবে এক বৃদ্ধাকে নিজ বাড়িতে হত্যা করার ঘটনা সেই আতঙ্ককে আরও গভীর করেছে।

অনেক ভোটার এখন নিরাপত্তার বিনিময়ে সামাজিক অগ্রগতির কিছু অধিকার ছাড়তেও রাজি। ইকিকুর অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক মিরনা মাতকোভিচের কথায়, কিছু বিষয়ে পিছিয়ে যাওয়া পছন্দ না হলেও শৃঙ্খলা ফেরাতে শক্ত হাত দরকার।

চিলি এখনো লাতিন আমেরিকার তুলনায় নিরাপদ দেশগুলোর একটি। কিন্তু অপরাধের ভয় মানুষের মানসিকতা, রাজনীতি আর ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে গভীর ছাপ ফেলছে। এই ভয়ই বদলে দিচ্ছে চিলির রাজনৈতিক মানচিত্র।