ডাবলিনের শীতল নভেম্বর সন্ধ্যায় আলিয়োনা বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। চার বছর আগে ইউক্রেনে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের ভয়ে দেশ ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে যে দেশে আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেই আয়ারল্যান্ডেই এখন তাঁর মনে হচ্ছে নিরাপত্তা ফুরিয়ে আসছে। শহরতলির সিটিওয়েস্ট হোটেলের সামনে পুলিশ গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাতে স্বস্তি নেই। কিছুদিন আগেই প্রতিবাদকারীরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরে গালাগাল করেছিল, মেয়ের কান্নার ভিডিও তুলেছিল, আর পুলিশ তখনও নীরব ছিল বলে তাঁর অভিযোগ।
স্বাগত থেকে সন্দেহের পথে
আয়ারল্যান্ড একসময় নিজেকে পরিচয় দিত ‘হাজারো স্বাগত’-এর দেশ হিসেবে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জরুরি আইনের মাধ্যমে দেশটি এক লাখেরও বেশি নারী ও শিশুকে আশ্রয় দেয়। বিমানবন্দরে স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড়, খাবার আর কাপড় দেওয়ার দৃশ্য ছিল সাধারণ। আলিয়োনার মতো শরণার্থীরা ভেবেছিলেন, এখানেই ভবিষ্যৎ গড়বে তাঁদের সন্তানরা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই আবহ বদলাতে শুরু করেছে। সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ, পথে বিক্ষোভ আর আশ্রয়কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় শরণার্থীদের মনে ঢুকেছে ভয়।

বিক্ষোভের আগুন আর আশ্রয়কেন্দ্রের আতঙ্ক
দেশজুড়ে তিন শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। অক্টোবরে এক ভবনে আগুন লাগার সময় দমকলকর্মীরা ছাদ থেকে চার শিশু আর তাদের মাকে উদ্ধার করেন। সিটিওয়েস্ট হোটেল হয়ে উঠেছে এই উত্তেজনার প্রতীক। এক যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ঘিরে সেখানে দুই রাত ধরে দাঙ্গা চলে। হাজার হাজার মানুষ গাড়ি পোড়ায়, ইট ছোড়ে, পুলিশকে লক্ষ্য করে আতশবাজি ছোড়ে। ভেতরে থাকা ইউক্রেনীয়রা বলছেন, শব্দ আর ভয় তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল।
জনমত বদলাচ্ছে, কড়া নীতির দাবি
দীর্ঘদিন অভিবাসনকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ এখন আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নিয়ম কঠোর করার পক্ষে। বাড়িভাড়া আর বাসস্থানের সংকট তীব্র হওয়ায় অনেকে মনে করছেন, শরণার্থীদের পেছনে বিপুল সরকারি ব্যয় স্থানীয়দের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। এক ইতিহাসবিদের ভাষায়, আয়ারল্যান্ডে যা ঘটছে তা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছে, যদিও এটি একটি অভিবাসী-উৎপাদক দেশের জন্য গভীর বৈপরীত্য।

গুজব, সামাজিক মাধ্যম আর রাজনৈতিক সুযোগ
বিক্ষোভের আগের রাতগুলোতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো অসমর্থিত খবর উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিদেশে জন্ম নেওয়া কাউকে ঘিরে অপরাধের গুজব মুহূর্তে লাখো মানুষের কাছে পৌঁছায়। অভিবাসনবিরোধী গোষ্ঠীগুলো ত্রিবর্ণ পতাকা টাঙিয়ে শ্লোগান দেয়, ‘আয়ারল্যান্ড আয়ারল্যান্ডবাসীর জন্য’। এর প্রভাব পড়ছে বহু বছর ধরে থাকা অভিবাসীদের ওপরও। ভারতীয় প্রযুক্তি কর্মী ফারিদ রহমান বলছেন, একসময় যে এলাকায় তাঁর সন্তানরা নির্বিঘ্নে খেলত, সেখানে এখন ভয়ের ছায়া।
সিটিওয়েস্টকে ঘিরে স্থানীয় ক্ষোভ
একসময় পর্যটন আর কোয়ারান্টিন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত সিটিওয়েস্ট হোটেল ২০২২ সালে ইউক্রেনীয়দের আশ্রয়স্থল হয়। পরে সেখানে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রক্রিয়াকরণ শুরু হলে স্থানীয়দের অস্বস্তি বাড়ে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া ছোট শহরে গুজব ছড়ায়, সরকার নাকি স্থায়ীভাবে হোটেল কিনছে। শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হন, কারণ তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি বলে অভিযোগ।

শরণার্থীদের চোখে ভাঙা নিরাপত্তা
দাঙ্গার পর আলিয়োনা আর তাঁর মেয়ে বাইরে বেরোতে ভয় পান। এক রাতে গাড়ি আটকে প্রতিবাদকারীরা চিৎকার করে বলে, এই রাস্তা তাদের। মেয়ের চোখের সামনে ক্যামেরা ধরায় আলিয়োনার মনে প্রশ্ন জাগে, একটি শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ কেন। তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, তদন্ত চলছে বলে জানানো হয়েছে। তবু ভয় কাটেনি।
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
শরণার্থীদের পক্ষে কাজ করা শিক্ষক আর কর্মীরা বলছেন, ক্ষোভ নীতিনির্ধারকদের দিকে থাকা উচিত, দুর্বল পরিবারগুলোর দিকে নয়। তাঁদের বিশ্বাস, আয়ারল্যান্ডের হৃদয়ে এখনও সহমর্মিতা আছে। কিন্তু আলিয়োনা নিশ্চিত নন। যে দেশে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেখানে এখন তাঁর মেয়ে আতশবাজির শব্দে কেঁপে ওঠে। যুদ্ধ থেকে নিরাপদে নিয়ে আসার পর তিনি নিজেকে আটকে পড়া এক নতুন ছোট যুদ্ধে দেখছেন।


সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















