সিডনির বন্ডি সৈকতে রোববার সন্ধ্যায় আনন্দের উৎসব মুহূর্তে নেমে আসে আতঙ্ক। পরিবার ও পর্যটকদের উপস্থিতিতে হানুক্কা উপলক্ষে আয়োজিত সমুদ্রতীরের অনুষ্ঠানে হঠাৎ বন্দুকধারীদের হামলায় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা ও রক্তক্ষয়। সেই বিভীষিকার মাঝেই মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ফলের দোকানি আহমেদ আল আহমেদ।
বন্ডি সৈকতে রক্তাক্ত সন্ধ্যা
জনপ্রিয় বন্ডি সৈকত রোববার সন্ধ্যায় পরিণত হয় সহিংসতার মঞ্চে। উৎসবের ভিড়ে গুলি ছোড়া শুরু হলে একাধিক মানুষ নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে। চারদিকে ছুটোছুটি আর আর্তচিৎকারের মধ্যে জীবন বাঁচানোর সুযোগ খুঁজছিল মানুষ।
এক মুহূর্তের সাহসী সিদ্ধান্ত
ঠিক সেই সময় সাদা শার্ট পরা এক ব্যক্তি ছুটে যান বিপদের দিকে। নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি কালো পোশাক পরা এক বন্দুকধারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাকে মাটিতে ফেলে অস্ত্র কেড়ে নেন এবং দূরে ছুড়ে দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ধরা পড়ে সেই দৃশ্য। এই মানুষটি আহমেদ আল আহমেদ, দুই সন্তানের বাবা, সিরীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় মুসলিম এবং সিডনির সাদারল্যান্ড শায়ারের এক সাধারণ ফল বিক্রেতা।
বিবেকের তাড়নায় এগিয়ে যাওয়া
আহমেদের চাচাতো ভাই মুস্তাফা আল আসাদের ভাষায়, এই কাজ কোনো পরিকল্পনা থেকে নয়, এসেছিল বিবেকের তাড়না থেকে। মানুষের রক্তে ভেজা মাটি আর পরিবারগুলোর আর্তনাদ তিনি সহ্য করতে পারেননি। মানবিক দায়বোধই তাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করে।
গুলিবিদ্ধ হয়েও জীবন রক্ষা
বন্দুকধারীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় আহমেদ দুইবার গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর হাত ও কাঁধে গুরুতর আঘাত লাগে। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। গুরুতর হলেও তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানানো হয়। এই সাহসী পদক্ষেপে অসংখ্য প্রাণ বাঁচতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি ও গর্ব
ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত এই সাহসিকতার প্রশংসা করেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার ক্রিস মিন্স হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে দেখতে যান। অনেকের চোখে এই দৃশ্য ভেঙে দেয় পরিচয় আর সহিংসতা নিয়ে গড়ে ওঠা সহজ ধারণা। মুসলিম পরিচয়ের একজন মানুষ ইহুদি উৎসবে অংশ নেওয়া মানুষদের রক্ষায় নিজের জীবন বাজি রেখেছেন, যা ইসলামবিদ্বেষ ও ইহুদিবিদ্বেষের উত্থানের সময়ে গভীর বার্তা দেয়।

পরিবারের গর্ব আর প্রার্থনা
আহমেদের বাবা মোহাম্মদ ফাতেহ আল আহমেদ বলেন, মানুষ রক্ষা করার তাগিদ তাঁর ছেলের ভেতর সব সময় ছিল। রক্তাক্ত দৃশ্য দেখেই তাঁর বিবেক সাড়া দেয়। মা মালাকেহ হাসান আল আহমেদ সন্তানের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেন এবং বলেন, গুলি শেষ হলে সে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল, যদিও নিজে আহত হয়।
সিরীয় শেকড়, অস্ট্রেলীয় জীবন
আহমেদের পরিবার সিরিয়ার ইদলিব অঞ্চল থেকে আসা প্রবাসী। যুদ্ধ আর বাস্তুচ্যুতির ইতিহাস পেছনে ফেলে তারা অস্ট্রেলিয়ায় নতুন জীবন গড়ে তোলে। বহু সংস্কৃতির সহাবস্থানের সেই সমাজেই বড় হয়েছেন আহমেদ। মসজিদের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া, প্রতিবেশীদের প্রতি উদার আচরণ আর পরিবারকেন্দ্রিক জীবনই ছিল তাঁর পরিচয়।

নায়ক হলেও বিনয়ী মানুষ
হামলার আগে তাঁর জীবন ছিল একেবারেই সাধারণ। কেউ ভাবেনি তিনি সন্ত্রাসের মুখে সাহসের প্রতীক হয়ে উঠবেন। ঘটনার পর চিকিৎসা খরচ ও পরিবারের সহায়তায় তহবিল গড়ে ওঠে। অনেকে দান করেছেন এই বিশ্বাস থেকে যে, আহমেদের গল্প আমাদের অভিন্ন মানবিকতার কথা মনে করিয়ে দেয়। কাছের মানুষদের ভাষায়, তিনি নিজে কোনো খ্যাতি চান না, নীরবে নিজের মতোই থাকতে চান।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















