স্বদেশ রায়
সত্তরের দশকের শেষেও আমরা মজা করে বলতাম, মীর জুমলা ঢাকায় ঢোকার গেট তৈরি করেছিলেন, কিন্তু ঢাকা থেকে বের হবার কোন গেট তৈরি করেননি। তাই ঢাকায় ঢোকা যায় কিন্তু বের হওয়া যায় না।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিনের মেয়র ফজলে নূর তাপস ঢাকা গেটটি সংস্কার করে ইতিহাস সংরক্ষনের একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেজন্য তাঁকে সকলে ধন্যবাদ দেবেন। কিন্তু এর বিপরীতে ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাবার যে অদৃশ্য গেটটি তৈরি হয়েছে, সেটা যে কোথায়- তা আমরা কি সত্যি অর্থে খুঁজে বের করতে পারছি? বা বের করার চেষ্টা করছি?
আজকাল বন্ধু বান্ধব কারো বাসায় যদি বেড়াতে যাই, কেন যেন মনে হয় এটা একটা ওল্ড হোম। কাউকে ফোনে দরকার হলে কয়েকবারেও তার ফোন ব্যস্ত পেলে রেখে দেই। পরে সে রিঙ ব্যাক করে বলে, তার ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলো। আর লিফটে বা অ্যাপার্টমেন্টের করিডোরে তো সব সময় এক কথা, ছেলে ফিরেছে কি, মেয়ে আসবে কবে? আমার মেয়ে তো এ মাসেই চলে যাচ্ছে।

গ্লোবালাইজেশানের যুগে একদিক থেকে এ অত্যন্ত ভালো একটা দিক যে ঢাকা থেকে বের হবার একটি অদৃশ্য বড় গেট তৈরি হয়েছে। আর সেই গেট দিয়ে বড় একটি অংশ বিদেশে যাচ্ছে। তবে বিদেশে যাওয়া আর দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক।
যেমন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জ্জী কোলকাতা সম্পর্কে বলেছেন, কোলকাতা থেকে সকলে বের হয়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ ব্যানার্জ্জী নিজেও কিন্তু কোলকাতা থেকে বেশ ছোট বেলাতেই বের হয়ে গেছেন। তাকে অর্মত্য সেনের মতো বাধ্যতামূলক কোলকাতা ছাড়তে হয়নি। অর্মত্য সেনের কোলকাতা ছাড়ার পেছনের যেমন একটা রাজনৈতিক চাপ ছিলো অভিজিতের বেলা সেটা ঘটেনি। তিনি নিজেই চলে গিয়েছিলেন।
তাই বাঙালি ছেলে মেয়েদের এই মূল শহর ছাড়া শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকে। এখন গোটা কোলকাতা ওল্ড হোম। অন্যদিকে ৪৮ এর পর থেকে ধীরে ধীরে ঢাকা গড়ে উঠতে থাকে বাঙালি ছেলে মেয়েদের জন্যে আরেকটি মূল নতুন শহর হিসেবে। সত্তর দশকের শেষ অবধি এই ঢাকায় শুধু ঢোকা যেত,এখান থেকে বের হবার গেটটি তৈরির কোন তাড়া ছিলো না।

অন্যদিকে ষাটের দশকে কোলকাতা ছেড়েছিলো একদল তরুণ নকশাল হবে না বলে, আরেক দলকে ছাড়তে হয়েছিলো, নকশাল মনে করে তাদেরকে না মেরে ফেলা হয় এই ভয় থেকে। আর এখন ছাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করতে একজন বন্ধু বেশ মজা করে বললো, যে রাজ্যে ঘুঘনি বানানো কে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়, সেখানে সি.ই.ও হলে তো তাকে ফুটপাতে দাঁড়িয়েই অফিস করতে হবে। তার থেকে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর বা গুজরাটে গেলে অন্তত একটা ছাঁদের নীচে অফিস করতে পারবে।
তার এই রসিকতার ভেতর দিয়ে কোলকাতা কেন ওল্ড হোমে পরিনত হয়েছে তা পরিস্কার হয়ে যায়।
অন্যদিকে ঢাকার সঙ্গে তিন ঘন্টায় যোগ হয়ে গেছে দক্ষিনবঙ্গ যেখান থেকে সত্তরের দশকেও ঢাকা আসতে কখনও কখনও বাইশ ঘন্টারও বেশি লেগে যেতো। ঢাকায় মেট্রো রেল চলছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেস হয়েছে। দ্রুত ঢাকার দক্ষিন থেকে উত্তরে আবার উত্তর থেকে দক্ষিনে পৌঁছানো যাচ্ছে। তারপরেও কেন ঢাকা থেকে মেধাবি তরুণরা, মধবিত্ত ঘরের তরুণরা বের হয়ে যাচ্ছে?

মেট্রোরেল কোলকাতাতে ষাটের দশকেই তৈরি শুরু হয়েছিলো। সত্তরেই সেখানে মেট্রোরেল মানুষের জীবনে দৈনন্দিন হয়ে যায়। আর নব্বই এর দশক থেকে বাজেট এয়ার এসে গোটা ভারতবর্ষের সঙ্গে কোলকাতা যুক্ত হয়ে গেছে। আগে যেখানে শিলিগুড়ি যেতে দুই দিনের প্রস্তুতি নিতে হতো এখন সেটা ৪৯ মিনিটে যাওয়া যায়। খরচও আগের থেকে অনেক কম। এমনকি ব্যাঙ্গালোর আর কোলকাতাকে পাশাপাশি শহর মনে করে সবাই। তারপরেও কোলকাতা মেধা ধরে রাখতে পারছে না।
তাই ঢাকার এই অবকাঠামোর পরেও কেন মেধা চলে যাওয়া শুরু হয়েছে এ জন্য একবার হলেও কোলকাতকে স্টাডি করে নেয়া যেতে পারে। হয়তো কিছু উত্তর সেখান থেকে আসবে। আরো একটি উত্তর আসবে সেটা হলো, কোলকাতা থেকে অধিকাংশ যাচ্ছে ফুটপাতের বদলে কাজের সময় মাথার ওপর একটা ছাঁদ পাবে বলে।

বাস্তবে যে বিদেশে চলে যাচ্ছে বা যাবার জন্যে ছুটছে সেখানেও কি খুব ভালো কিছু তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে? পৃথিবীতে সব থেকে ভালো দেশ ছিলো আমেরিকা। যেখানে যোগ্যতাকে সবার আগে সব থেকে বেশি মূল্য দেয়া হতো। সে দেশটিও দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে বাঙালির সব থেকে আকর্ষনীয় স্থান ছিলো লন্ডন শহর সহ গোটা ব্রিটেন দেশটি। সেখানে এখন বাঙালিদের আয় করে চলার পথ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কালো টাকা যাদের সন্তানদের জন্যে যাচ্ছে, তারা শুধু ভালো আছে। আর জাতি হিসেবে পৃথিবীর সেরা বেনিয়া বৃটিশ। পৃথিবীর তাবৎ ভালো আইনগুলো তাদের তৈরি। আবার তাদের দেশটিই কালো টাকা সংরক্ষণের সব থেকে ভালো জায়গা। আমাদের শিল্পিমনারা এক সময়ে ফ্রান্সে গিয়ে ভালোই থাকতো। এখন ফ্রান্স এর সমাজ কাঠামোও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু আমাদেরকে নয় সমগ্র এশিয় ও তাদের এক সময়ের কলোনি আফ্রিকান দেশগুলোর মানুষকেও আর গ্রহন করতে অতটা ইচ্ছুক নয়। তাছাড়া সার্বিক ইউরোপের অর্থনীতি প্রতিদিন একটা ঝুঁকি পার হচ্ছে।
ইউরোপের পরে গন্তব্য খুঁজে ফিরছে ছেলে মেয়েরা উত্তর আমেরিকায়। সেখানে যারা যাচ্ছে তাদের অনেকেরই বক্তব্য, আমার জীবনটা টানাটানির মধ্যে দিয়ে চলে যাবে। তবে পরবর্তী জেনারেশানকে একটা ভালো দেশে রেখে যেতে পারবো। একটা দামী পাসপোর্ট পাবে সে।

যেমন পরিচিত একজন তার চল্লিশ অবধি তার বয়স অনুযায়ী ভালোই করছিলো ঢাকায়। তারপরে বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে, নিজের স্ট্যাটাসের সঙ্গে মিলিয়ে আর ওইভাবে কিছু করতে পারছিলো না। যাহোক, কোন মতে উত্তর আমেরিকার একটি দেশে ইমিগ্রান্ট ভিসা জোগাড় করে চলে যায়। সেও এখন নিজেকে প্রবোধ দেয়, যাহোক, ভালো একটা পাসপোর্ট তো পেয়েছি। অধিকাংশ দেশের ভিসা চাওয়া লাগে না। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যে কোন দেশের ভিসা চাওযার অর্থ হলো যেন তাদের কাছে কোন কিছু ভিক্ষা চাওয়া হচ্ছে। এর থেকে তো মুক্তি পেয়েছি।
এই ধরনের সান্তনা বাঙালি বা ভারতবাসীকে চিরকাল পেতে শুনেছি বা দেখেছি। এমনকি বাঙালির সব থেকে মনোবলের স্থান যে নজরুল, তিনিও বলেছিলেন, হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান। অথচ সন্তানের চিকিৎসার জন্যে তাকে ভিখারির মতো অর্থ খুঁজতে হয়েছে। অর্থাৎ তখনও তার শহর তার দেশ তার যোগ্যতার মূল্য দেয়নি।
অবশ্য সে সময়ে আরেকটি সান্তনা ছিলো, “ আমরা পরাধীন”। স্বাধীন থাকলে এমন হতো না। যতদিন কোন জাতি পরাধীন থাকে তখন সে স্বাধীনতার উম্মাদনায় বুঝতে পারেনা, আসলে স্বাধীনতা চিরকাল ওপরতলার বাসিন্দা। নিচের তলাটা সব সময়ই মহান স্রষ্টা সাধারনের জন্যে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার ওখানে বেড়াতে আসারও সময় নেই।

ইউরোপ, আমেরিকা, উত্তর আমেরিকার পরে থাকে চায়না, জাপান ও তার সঙ্গে দক্ষিনপূর্ব এশীয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো। এই দেশগুলো সত্যি অর্থনীতিতে ভাল করছে। তারা ভালো করছে ঠিকই। তবে এই রেজিমেন্টেড নেশানগুলো তাদের দেশের নিয়মকানুন সহ সুযোগ সুবিধা একেবারে নিজেদের জন্যেই শক্ত করে তৈরি করেছে। সেখানে সীমাহীন পরিশ্রম করেই আমাদের সন্তানগুলো চলছে। যেমন বর্তমান পৃথিবীর উন্নতির পথে ধাবমান অর্থনীতি দক্ষিন কোরিয়ায় থাকা এক বাঙালি ছেলে তার বাবা-মাকে সান্তনা দিচ্ছে, “ আমি হয়তো তোমাদের শেষ বয়সে তোমাদেরকে এখানে একবার নিয়ে এসে একটা ভালো চিকিৎসা দিতে পারবো”। অথচ এই তো মাত্র মাস দুয়েক আগে সারাক্ষণে আমেরিকান এক প্রফেসরের দক্ষিন কোরিয়ার চিকিৎসার অভিজ্ঞতার কাহিনী ছেপেছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সাধারন একটি হাসপাতালে তিনি হুইল চেয়ারও পাননি । তার ছাত্ররা একটি সাধারণ চেয়ারে তাকে বসিয়ে সকলে মিলে উঁচু করে হাসপাতালের সিড়ি পার করে।
বাঙালি ওই ছেলেটির আশা করায় কোন দোষ নেই। কারণ, পিতার জন্যে পরশুরামের কুঠারের ইতিহাস পৃথিবীতে আছে- আর জননী তো জম্মভূমি ও স্বর্গের থেকেও বেশি। তাই তাদের একটি ভালো চিকিৎসার স্বপ্ন সে দেখতেই পারে। তবে সে তরুণ, সে জানে না- সব দেশের ভালো চিকিৎসাটা ওপরতলায় থাকে। সেখানে এয়ার এম্বুলেন্সে যেতে হয়। ভাড়ার ট্যাক্সিতে পৌঁছানো যায় না।

সারা পৃথিবীতে সবখানেই যখন পা রাখা কঠিন হয়ে গেছে , তারপরেও আমাদের ছেলে মেয়েরা ঢাকা ছাড়ার অদৃশ্য গেটটি দিন দিন অনেক বড় আকারের তৈরি করছে। কোন অদৃশ্য মীর জুমলা তাদের এই ঢাকা ছাড়ার গেটটি তৈরি করে দিচ্ছে- তাকে কি এখনই চিহ্নিত করার সময় নয়?
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Sarakhon Report 


















