শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩২ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-১০)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

ইদানীং বড় ঘুম পাচ্ছে তুষ্টির।

ঠিক ঘুমও নয়। তন্দ্রার মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে  ইচ্ছা করে। সকালে উঠি উঠি করেও ঘুম ভাঙতে চায় না।

ঘুমের ভেতর সে স্বপ্ন দেখে। এক ঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে যাচ্ছে সীমাহীন নীলের ভেতর দিয়ে। ওদের পাখনায় নীলাকাশের দ্যুতি। ওরা উপর থেকে খুঁজে ফিরছে এক নিরাপদ বন। যেখানে গাছেরা কথা বলতে পারে। ফুলেরা কোমর দুলিয়ে বাতাসের সঙ্গে নাচতে জানে। আর পাখিরা মনের আনন্দে গান গায়, শিস দেয় , ঘন ঘন কথা বলে নিজেদের ভেতর Ñ টুউ , টুউ।

হঠাৎ স্বপ্নটা ভেঙে গেল মায়ের ডাকে। সে আড়মোড়া ভাঙে। কিছুতেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় ঘুম ভাঙলেই সবাই ওকে খামচে ধরবে। এটা-ওটা বলে ক্ষ্যাপাবে। বিস্বাদ খাবারের মতন ঘাড় ধরে ওকে পড়তে বসাবে। অথচ পড়ার টেবিলে বসলেই ইদানীং যে কী হয়, কিছু আর মনে করতে পারে না। রচনার পর রচনা সে পড়ে চলেছে। কিন্তু  ঘণ্টা দুয়েক পরই মাথা থেকে সব গায়েব হয়ে যায়। চোখের সামনে সহসা ভেসে ওঠে  চিড়িয়াখানায় দেখা লম্বা গলাওলা জিরাফটা। আঁকশির মতন ওরও যদি  এরকম একটা লম্বা গলা থাকত ? তাইলে নিশ্চয়ই বড় বড় আমগাছ থেকে আম পেড়ে খেতে পারত। পাকা টসটসে এক-একটি আম। হলুদ গায়ের রঙ। কোনটার আবার সিঁদুরে রঙ। দেখলেই দাঁত দিয়ে ছোট একটা ছিদ্র করে চুষতে ইচ্ছে করে। কালিকচ্চের  বাড়িটা যখন ছিল তখন উঠোনের সবচেয়ে বড় আমগাছটায় কতবার উঠেছে সে। সঙ্গে ছিল ওর গেছো কাকাতো বোন শীলা। বুনো সব ইচ্ছার কথা ওরই কাছ থেকে সে জানতে পারত। সে-ই ওকে শেখায় কিভাবে অনায়াস চেষ্টায় গাছের মগডালে চড়ে বসতে হয়। এমন কী, গাছের ত্রিকোণ ডালের বেড়াজালে হেলান দিয়ে কি করে ঘুমানো যায় তাও ওর কাছে শেখা। সেই শীলা এখন মানসিক ভারসাম্যহীন। থাকে ব্রাম্মণবাড়িয়া শহরের এক ভাড়া বাসায়। কাকু মাঝে মাঝে চিকিৎসার কারণে ওকে নিয়ে ঢাকায় আসে। কিন্তু প্রাণোচ্ছল সদালাপী শীলাকে এখন আর চেনা যায় না। কেমন যেন ভয়-ভয় করে।

সহসা পড়ার মাঝখানে তুষ্টির খুব ইচ্ছে করে কার্টুন দেখতে। কার্টুনের চরিত্রগুলো ওর মাথার পরতে পরতে টর্পেডো ব্যাংঙের মতন লাফায়। ওরা ওর মনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে চায়। পড়াগুলো সকালবেলায় মায়ের দেয়া চিরতার জলের মতো লাগে। অসহ্য মনে হয় সব।

সৃষ্টি ওকে লক্ষ্য করে। বলে,‘ দিদি, তুই ক্যামন যেন হয়ে যাচ্ছিস ? এখনও তুই কার্টুনে মজা পাস?’

তুষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তপতী এসে ওর গা ঘেষে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটাকে লক্ষ্য করে। তারপর মুখ খোলে ,‘হ্যারে তুষ্টি, আগে তুই লাফ দিয়ে সবার আগে বিছানা থেকে উঠতি, এখন হাজার ডেকেও সাড়া মেলে না। দিন দিন মানুষ চালাক হয়। তুই এরকম হচ্ছিস ক্যান ?’

এরকমটা কি Ñ তপতী তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। তবে মা হিসাবে সেও বুঝতে পারে মেয়েটা সাঁতার কাটতে গিয়ে কোনো এক শৈবালদামে আটকে গেছে। কিছুতেই পথ খুঁজে পাচ্ছে না। মায়া হয় ওর জন্যে। জ্যেষ্ঠ সন্তান। এখনও মুখে খাবার গুজে দিতে হয়। কষ্ট হয় বড়। বুকটা মাঝে মাঝে পুড়তে শুরু করে।

সত্যটা জানতে লুকিয়ে সৃষ্টিকে গায়ে পড়ে তপতী জিজ্ঞাসা করে,‘হ্যারে, তুষ্টির কি কিছু হয়েছে ?’

‘কি জানি। ওরেই জিগাও।’ ঠোঁট উল্টায় সৃষ্টি। যেন এ নিয়ে যত মাথাব্যথা সব মায়ের। ওর নয়।

ব্যাপারটা তাপসকেও অবহিত করে। বাবা হিসাবে সে খুবই সমজদার মানুষ। দুই মেয়ের সাথে তার ব্যবহার আন্তরিক ও প্রাণবন্ত। তপতীর মুখে শুনে সে মেয়ের বিছানায়  গিয়ে বসে। তারপর একটিও কথা না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তাপসের কেন যেন মনে হয়, ওর চুপচাপ মেয়েটা প্রচন্ড মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কদিন আগেও যে মেয়েটা নিজে থেকে গীটার বাজিয়ে ওকে নতুন কোন গানের কলি শোনাত, সে এখন দিনদিন চুপচাপ হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে , তাপসকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন সে বাঁচে।

তুষ্টি পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলে তাপসও ওকে অনুসরণ করে। অনেক্ষণ পর মমতাভরা গলায় বলে ওঠে,‘আমারে একটা গান শোনাবি , মা ?’

তুষ্টি পড়ায় ডুবে যাওয়ার ভান করে। তাপস ফের অনুরোধ করে। এবার সে মুখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। সেই দৃষ্টিতে একধরনের ক্লান্তি জমে আছে Ñ স্পষ্ট লক্ষ্য করে তাপস।

‘অনেকদিন তোর গলায় গান শুনি না। শোনা না ?’

অগত্যা, তুষ্টি গাইতে শুরু করে,‘ ওলো সই, ওলো সই , আমার ইচ্ছা করে তোদের  মতো মনের কথা কই।’

তাপস লক্ষ্য করে মেয়ের গলার স্বরে আগের সেই উদাত্ত ভাব নেই। যে স্বরের ওঠানামায় আমোদ ও উচ্ছলতা মিশেছিল তা যেন ক্ষণে ক্ষণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাপসের বড় মায়া হল তুষির জন্যে।

সে তপতীকে বলল,‘ওর আদর দরকার।’

মুখ ঝামটা দেয় তপতী ,‘ তুমি দিও। ’

তাপস চুপসে যায়। কেন যেন মেয়েটার কিশোরী কষ্টগুলো নিজের করে নিতে ইচ্ছা করছে বড়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024