মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:১৬ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার অন্ধ দাদা

দাদা অন্ধ ছিলেন। কিন্তু আমি আর নেহা দু’ভাই তাঁর দুইটি চক্ষু দিলাম। দাদা যখন যেখানে যাইতেন, লাঠি ধরিয়া তাঁর আগে আগে যাইতাম। মাঠের পথ দিয়া চলিতে চলিতে চাষীভাইরা ক্ষেতের কাজ ফেলিয়া ডাক দিত, “মোল্লাজি। একটু জিড়াইয়া যান।” লাঠি ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইত তাদের ক্ষেতের আলিতে। অন্তত আধঘণ্টা শ্লোক সমস্যা বলাইয়া, নানারকমের গান গাওয়াইয়া তবে তাহারা দাদাকে ছাড়িয়া দিত। দাদা ছিলেন গ্রামদেশের আনন্দের প্রতীক। যেখানে যাইয়া বসিতেন সেখানেই আনন্দের বন্যা বহাইয়া দিতেন। তাই গ্রামপথ দিয়া যাইতে বাড়ির বউঝিরা ছোটদের দিয়া দাদাকে ডাকাইয়া লইয়া যাইত। বাড়িতে ভালো কিছু খাবার থাকিলে দাদাকে খাইতে দিত। বলা বাহুল্য আমরাও তার ভাগ পাইতাম। খাইতে দিয়া বউঝিরা তাহাদের সুখ দুঃখের কথা বলিত। স্বামী মারিয়া পিঠে দাগ করিয়া দিয়াছে। দাদা বউটির পিঠে হাত বুলাইয়া দিতেন।

কারও বাপ আসিয়াছিল মেয়েকে লইয়া যাইতে, যাইতে দেয় নাই। এদেশে একটা আম-কাঁঠালের মুখ দেখিবার জো নাই, মেয়েটির বাপের বাড়িতে আম-কাঁঠাল গড়াগড়ি যায়। দাদা সকল কথা খুব মনোযোগ দিয়া শুনিতেন। কখনও কখনও সমবেদনায় তাঁর চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হইত। তারপর কি কৌশলে গল্প করিয়া গান গাহিয়া সেই বিষাদপূর্ণ মুখগুলিতে হাসি ফুটাইয়া দিয়া তবে বিদায় লইয়া ফিরিতেন। দাদা বিবাহ করিয়াছিলেন আমাদের বাড়ি হইতে আড়াই মাইল দূরে গোয়ালচামটের মুন্সীর মাকে। অন্ধ মানুষের সঙ্গে কে আর কুমারী মেয়ের বিবাহ দিবে? এই বিধবা মহিলাটি দাদার ঘর করিতে আসিলেন। আগেই তো বলিয়াছি, আমার পরদাদার মৃত্যুর পর পদ্মায় জমিজমা ভাঙিয়া লওয়ায় আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হইয়া পড়ে। দাদার ভাগে যা জমিজমা পড়ে তা বরগা দিয়া সামান্য মাত্র কয়েক মাসের খোরাকি হইত।

তা দাদা নিজেই খাইবেন, না বউকে খাওয়াইবেন। আমার পিতা বা তাঁর অন্যান্য ভাজতেরা যে সাহায্য করিবেন তাঁদেরও অবস্থা ভালো ছিল না। একবেলা খাইয়া, আধপেটা খাইয়া, দু’একমাস পরে দাদি চলিয়া যাইতেন। তখন দাদা আমার চাচাদের সঙ্গে খাইতেন। কয়েক মাস যাইতে না যাইতে গ্রামের একে ওকে সঙ্গে লইয়া দাদি আবার ফিরিয়া আসিতেন। দাদির বাড়ির ধারে ছিল অনেক বহেরার গাছ। আসিবার সময় দাদি এর যতগুলি সম্ভব বোঁচকায় করিয়া বাঁধিয়া আনিতেন। তারপর সেগুলি পাটায় ছেঁচিয়া শাঁস বাহির করিয়া আমাকে খাইতে দিতেন। দাদার মতো

দাদিও আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন। পরে দাদির ছেলে মুন্সী খাঁ বড় হইয়া উঠিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করিয়া তার অবস্থা ভালো হইল। আমাদের বাড়িতে আসিলে মায়ের অযত্ন হয়-পেট ভরিয়া খাইতেও পায় না। তাই সেবার আসিয়া সেই যে সে দাদিকে লইয়া গেল আর তাঁকে আমাদের বাড়ি আসিতে দিল না। ইহার কয়েক বৎসর পরে তিনি মারা গিয়াছেন। আমার ভাসা-ভাসা মনে পড়িতেছে স্নেহাতুরা সেই মহিলাটিকে। গায়ের বর্ণ শ্যাম। মুখে-চোখে বার্ধক্যের দাগ। তিনি কত আদর করিয়া আমার হাত-পা ধোয়াইয়া আমাকে ঘরে লইয়া যাইতেন।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024