শশাঙ্ক মণ্ডল
ধর্মান্তরিত এ সব মানুষরা ইসলামধর্মের অভ্যন্তরে তাদের পুরানো আচার আচরণ পেশা নিয়ে পড়ে রইলেন। কৃষিজীবী সমাজের তলাকার মানুষ স্বভাবতই রক্ষণশীল হবার জন্য পুরানো আচার আচরণ পরিত্যাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হল না। প্রথম যুগের হিন্দু মুসলমান বিরোধ ধীরে ধীরে তা দূরীভূত হতে থাকল। ষোড়শ শতাব্দীতে হুসেন শাহ চৈতন্য দেব সুফিসাধকদের প্রভাবে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হল। অবিমিশ্র সংস্কৃতি কখনও টিকে থাকে না-পরস্পরের মেলামেশার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি সমন্বয় ঘটে।
ধর্ম কেবলমাত্র মানস জিজ্ঞাসা নিবৃত্তির উপায় নয় ব্যবহারিক বিধি তথা জীবনের আচার আচরণের নীতি- নির্ধারণও করে। দীর্ঘকাল অনুসৃত আচারণ স্থানিক সংস্কৃতিকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়- তা ঘুরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কথায় বলে Customs die hard. স্থানীয় আবহাওয়া, খাদ্য বস্তু, পোষাক প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা সামগ্রিক জীবনচর্যা স্থানীয় সংস্কৃতি বর্জনে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের ক্ষেত্রে একথা অত্যন্ত সত্য হয়ে দাড়াল। ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গে র পীর গাজীদের প্রভাব সমগ্র হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বেশি বেশি করে অনুভূত হতে থাকল।
উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পীর গাজীদের জীবনাদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল এবং এরই পাশাপাশি অনেক লৌকিক দেবতাকে মুসলমান সমাজ কিছুটা ইসলামিকরণের মধ্য দিয়ে তাদের আরাধ্য হিসাবে গ্রহণ করল; তাই বনদেবী হলেন বনবিবি, ওলাদেবী ওলাবিবি, গ্রামবন্ধন বাস্তুপূজা সুরাইয়া কলমা সহযোগে গ্রহণ করা হল এ ধরনের আরও অনেক গ্রহণ বর্জনের ছবি লৌকিক দেবদেবী পীর গাজীদের মধ্যে লক্ষ করা গেল। সকল ভক্ত পীরের দরগা নজরগাতে হাজত মানত সিন্নি দিয়ে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করত। মুসলমান আদর্শ অনুযায়ী অনেক পীরের পবিত্র স্থানে কোরান পাঠ হয় কিন্তু নমাজ হয় না।
হিন্দু আর্দশ অনুযায়ী বাতসা মিষ্টান্ন লুঠ দেওয়া হয়, সন্তান কামনায় বা রোগমুক্তির কিংবা বিভিন্ন মনস্কামনা পূর্ণ করার উপায় হিসাবে পীরের দরগায়, বাটুলতলায় ইটের টুকরো, ঢিল বাঁধা, ফুল দেওয়া বা পীরের জল শাস্তি বারি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মমতানুযায়ী অনেকক্ষেত্রে পীরের স্মরণে জীব হত্যা না করে মুরগি হাজত স্বরূপ বনে ছেড়ে দেওয়া হত। দরগার মেলা উপলক্ষে হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায় একসঙ্গে যুক্ত হত। পীর গোরাচাঁদের বিভিন্ন স্থানে যে দরগা বা আস্তানাগুলির সন্ধান পাওয়া গেছে তার পাশে ঘোষপাড়া অবশ্যই থাকতে হবে।
পীর গোরাচাঁদের উৎসব শুরুতে ঐ পবিত্র স্থানে দুধ দিয়ে পরিষ্কার করার দায়িত্ব এই হিন্দু গোপালকদের ওপর ন্যস্ত। এ সব পীরদের প্রভাব দক্ষিণ বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বিশেষ করে ২৪ পরগণা যশোর বরিশাল ফরিদপুর অঞ্চলে পড়েছিল। মঙ্গলকাব্যগুলির অনুকরণে অনেক কবি পীরদের জীবন কাহিনী অবলম্বনে অনেক কাব্য রচনা করেন। পীরের দিব্যজীবন কাহিনীর পাশাপাশি সমকালীন সাধারণ মানুষের টুকরো টুকরো জীবন কথা এ সব কাব্যে স্থান পেয়েছে।