শশাঙ্ক মণ্ডল
বদর পীর
নদী মাতৃক সুন্দরবনের মানুষদের বিশেষ আরাধ্য নদীদেবতার নাম দরিয়া পীর। নদীতে নৌকা চালানোর ক্ষেত্রে যাতে কোন বিপদ না হয় সেজন্য নৌকারোহী থেকে শুরু করে মাঝিমাল্লারা নৌকা যাত্রার শুরুতে বদর পীর সহ পাঁচ পীরের নাম স্মরণ করে। চিৎকার করে বলে ওঠে- “দরিয়ার পাঁচ পীর বদর বদর।” অনেকটা শ্লোগানের ভঙ্গ এতে একজন প্রথম অংশ উচ্চারণ করে অন্যরা শেষ অংশ উচ্চারণ করে। পাঁচ পীরের সকলের নাম অবশ্য জানা যায় না, নৌকা ভাসান উৎসব উপলক্ষে গঙ্গা পূজা করা হয় এবং নতুন নৌকা জলে ভাসানোর সাথে সাথে বদর পীরের নামে জয়ধ্বনি করা হয়। অনেকে পাঁচ পীরের নামে সিন্নি দিয়ে থাকে।
মাণিক পীর
সুন্দরবনের কৃষকদের কাছে মাণিক পীরের জনপ্রিয়তা অন্য কোন পীরের তুলনায় অনেক বেশি। আজও মাণিক পীরের ফকিররা গ্রামে গঞ্জে গান গেয়ে ফেরে এবং গৃহস্থরা মাণিক পীরের প্রতি শ্রদ্ধায় তার পূজার জন্য নানা উপহার সামগ্রী দান করে। মাণিক পীরের ‘জহুরী নামা’ জাতীয় পাঁচালীর গান এখনও গ্রামাঞ্চলে শুনতে পাওয়া যায়।
অসংখ্য মাণিক পীরের আস্তানা বা ‘থান’ সমগ্র সুন্দরবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায় সুন্দরবনের উত্তরাঞ্চলে অনেক আস্তানায় কম বেশি তিনশো বছর আগে থেকে মাণিক পীরের শিরনি দেওয়া হয়। বসিরহাটের নিকটবর্তী গোটরা গ্রামে মাণিক পীরের সেবাইতরা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে পীরোত্তর জমি লাভ করেছিলেন ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে। গোটরার ফকিররা এখনও মাণিক পীরের গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায় এবং বৎসরে একবার ধূমধামের সাথে মাণিক পীরের উৎসব করে থাকে। এই উৎসব হিন্দু মুসলমান মিলিত ভাবে অংশ গ্রহণ করে।
মূলত পশুরক্ষক দেবতা হলেও অন্যান্য উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মাণিক পীরের সিন্নি দেওয়া হয়। মাঝিমল্লাদের আরাধ্য পাঁচ পীরের অন্যতম একজন মাণিক পীর বলে অনেকে মনে করেন। ২৪ পরগণা খুলনা জেলায় মাণিক পীর স্মরণে এক দীর্ঘ কাহিনী কাব্য ‘মাণিক পীরের পালা’ লোক পরম্পরায় ফকিররা গেয়ে আসছে। পালার সূচনায় মাণিক পীরের চেহারার বর্ণনা আছে, পীরকে শ্যাম সুন্দর বলে অভিহিত করা হয়েছে, মুখে তার চাপ দাড়ি বর্ণনার মধ্যে বৈষ্ণব প্রভাব লক্ষ করা যায়।