০৬:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • 16

সন্ন্যাসী ঠাকুর

সন্ন্যাসী ঠাকুর চলিয়া যাওয়ার পর তাঁহার বাগানের এত যত্নের ফুলগাছগুলি শুকাইয়া যাইতে লাগিল। আমি ছেলেমানুষ। কত আর পানি ঢালিতে পারিব। সেই পানি আবার আনিতে হইত বহু পথ পার লইয়া নদী হইতে। অযত্নে ঘরের বেড়াগুলি পড়িয়া যাইতে লাগিল। সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য আমার মন আকুল হইয়া উঠিল। তিনি থাকিতে যেসব কঠোরতা অবলম্বন করিয়াছিলাম তাহা আরও কঠোরতম করিয়া লইলাম।

ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন। শ্মশানের আশ্রম আবার ভক্তজনমুখর হইয়া পড়িল। আমার কাহিনী আনুপূর্বক শুনিয়া তাহাতে আরও রং চং লাগাইয়া তিনি তাঁহার ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে প্রচার করিতে লাগিলেন। চারিদিকে আমার ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। আমি নিজেও বিশ্বাস করিতে লাগিলাম, সাধনপথে আমি অনেকটা অগ্রসর হইয়াছি।

হানিফ মোল্লার কথা ইতিপূর্বে বলিয়াছি। তাঁহার ছোট ভাই কাঙালী মোল্লা। সেও আমার মতো সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্ত ছিল; আমারই মতো মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন খাইত না। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিতেন, কালী সাধনায় সে তাঁর শিষ্যদের ছাড়াইয়া গিয়াছে। আমি কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুরকে কোনোদিনই তাহাকে যোগ-সাধনা শিখাইতে দেখি নাই।

ইহার দশ-বারো বৎসর পরে একদিন এই কাঙালী মোল্লা গল্পে গল্পে বলিল, “তুমি যে-রাত্রে শ্মশানঘাটে ছিলে, তোমার সাহস কতটা পরীক্ষা করিবার জন্য আমি গেটের দরজার নিশানের বাঁশ ঝাঁকাইয়াছিলাম, আর ঘরের বেড়ায় থাপ্পড় মারিয়াছিলাম।”

তাকে বলিলাম, “তবে তুমি সামনে আসিয়া পরিচয় দিয়া আমার ভয় ভাঙাইলে না কেন?”

সে উত্তর করিল, “এইভাবে তোমাকে ভয় দেখাইতে যাইয়া আমি নিজেও ভয় পাইয়া গেলাম। কি জানি তুমি যদি আমাকে হঠাৎ দেখিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া যাও, তখন পাড়ায় মুখ দেখাইতে পারিতাম?”

আমি বলিলাম, “চাচা! তুমি খুবই অন্যায় কাজ করিয়াছিলে। আমার মতো এতটুকু বয়সের একটি ছেলে যে এক রাত শ্মশানে একা বাস করিয়াছিল এই তো তার সাহসের কত বড় পরিচয়। আবার তাহাকে ভয় দেখাইতে গিয়াছিলে কেন? আমি যদি তখন চিৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িতাম?”

চাচা বলিল, “ভাজতে। তুমি আমাকে মাপ করিয়া দাও।”

ইহার আরও কিছুকাল পরে ফরিদপুরের কাছারিতে একদিন আমার সেই বালক-সন্ন্যাসী বন্ধুকে ভিক্ষা করিতে দেখিলাম। জেরা করিয়া জানিলাম যে, সে সত্যসত্যই ভিখারি। ছদ্মবেশী মা কালী নয়। তখন অপর লোকের প্রভাবে পড়িয়া এইসব অতি-ভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস হারাইয়াছি। সেকথা পরে বলিব। সুতরাং সেই বালক-সন্ন্যাসী যে ছদ্মবেশী কালী ঠাকুরুন নন সেজন্য আমার মনে কোনো দুঃখই হইল না।

চলবে…

 

আরব আমিরাত, মরুভূমি শহরে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০৫)

১১:০০:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫

সন্ন্যাসী ঠাকুর

সন্ন্যাসী ঠাকুর চলিয়া যাওয়ার পর তাঁহার বাগানের এত যত্নের ফুলগাছগুলি শুকাইয়া যাইতে লাগিল। আমি ছেলেমানুষ। কত আর পানি ঢালিতে পারিব। সেই পানি আবার আনিতে হইত বহু পথ পার লইয়া নদী হইতে। অযত্নে ঘরের বেড়াগুলি পড়িয়া যাইতে লাগিল। সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য আমার মন আকুল হইয়া উঠিল। তিনি থাকিতে যেসব কঠোরতা অবলম্বন করিয়াছিলাম তাহা আরও কঠোরতম করিয়া লইলাম।

ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন। শ্মশানের আশ্রম আবার ভক্তজনমুখর হইয়া পড়িল। আমার কাহিনী আনুপূর্বক শুনিয়া তাহাতে আরও রং চং লাগাইয়া তিনি তাঁহার ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে প্রচার করিতে লাগিলেন। চারিদিকে আমার ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। আমি নিজেও বিশ্বাস করিতে লাগিলাম, সাধনপথে আমি অনেকটা অগ্রসর হইয়াছি।

হানিফ মোল্লার কথা ইতিপূর্বে বলিয়াছি। তাঁহার ছোট ভাই কাঙালী মোল্লা। সেও আমার মতো সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্ত ছিল; আমারই মতো মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন খাইত না। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিতেন, কালী সাধনায় সে তাঁর শিষ্যদের ছাড়াইয়া গিয়াছে। আমি কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুরকে কোনোদিনই তাহাকে যোগ-সাধনা শিখাইতে দেখি নাই।

ইহার দশ-বারো বৎসর পরে একদিন এই কাঙালী মোল্লা গল্পে গল্পে বলিল, “তুমি যে-রাত্রে শ্মশানঘাটে ছিলে, তোমার সাহস কতটা পরীক্ষা করিবার জন্য আমি গেটের দরজার নিশানের বাঁশ ঝাঁকাইয়াছিলাম, আর ঘরের বেড়ায় থাপ্পড় মারিয়াছিলাম।”

তাকে বলিলাম, “তবে তুমি সামনে আসিয়া পরিচয় দিয়া আমার ভয় ভাঙাইলে না কেন?”

সে উত্তর করিল, “এইভাবে তোমাকে ভয় দেখাইতে যাইয়া আমি নিজেও ভয় পাইয়া গেলাম। কি জানি তুমি যদি আমাকে হঠাৎ দেখিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া যাও, তখন পাড়ায় মুখ দেখাইতে পারিতাম?”

আমি বলিলাম, “চাচা! তুমি খুবই অন্যায় কাজ করিয়াছিলে। আমার মতো এতটুকু বয়সের একটি ছেলে যে এক রাত শ্মশানে একা বাস করিয়াছিল এই তো তার সাহসের কত বড় পরিচয়। আবার তাহাকে ভয় দেখাইতে গিয়াছিলে কেন? আমি যদি তখন চিৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িতাম?”

চাচা বলিল, “ভাজতে। তুমি আমাকে মাপ করিয়া দাও।”

ইহার আরও কিছুকাল পরে ফরিদপুরের কাছারিতে একদিন আমার সেই বালক-সন্ন্যাসী বন্ধুকে ভিক্ষা করিতে দেখিলাম। জেরা করিয়া জানিলাম যে, সে সত্যসত্যই ভিখারি। ছদ্মবেশী মা কালী নয়। তখন অপর লোকের প্রভাবে পড়িয়া এইসব অতি-ভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস হারাইয়াছি। সেকথা পরে বলিব। সুতরাং সেই বালক-সন্ন্যাসী যে ছদ্মবেশী কালী ঠাকুরুন নন সেজন্য আমার মনে কোনো দুঃখই হইল না।

চলবে…