স্বদেশ রায়
১৯৭১ সালে শরনার্থী জীবনে আমাদের কাছে সব থেকে সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি যে ক’বার শরনার্থী শিবিরে এসেছেন, বা যখন যে শরনার্থী শিবিরে গিয়েছেন, সেখানে শরণার্থীদের শত কষ্টের মধ্যে একটা আশার আলো জেগে উঠেছে।
আজ এত বছর পরে এসেও মনে পড়ে আমাদের নেতাদের বাইরে ওই সময়ে শরনার্থী শিবিরে সব থেকে আশা যাকে ঘিরে ছিলো, যার নাম সব থেকে শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হতো, তিনি ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর থেকেও যারা বয়সে বড় তারাও তাঁকে সেদিন মাতৃজ্ঞানে সম্মান করতেন। তাছাড়া আজ এ বয়সে এসে বাঙালি সমাজ সম্পর্কে আমার উপলব্দি, বাঙালি বাইরে ও অর্থনৈতিকভাবে যা হোক না কেন, মানসিকভাবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজেই বিশ্বাসী। তাই বাঙালি তার থেকে কম বয়সী কোন মেয়েকেও মাতৃজ্ঞানে মেনে নিতে কোন দ্বিধা করে না।
ওই সময়ে শরণাথী শিবিরে সারাদিন রেডিওতে কান রাখা হতো এবং সকালের সংবাদপত্রে চোখ রাখতো সকলে- শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শরনার্থী বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কিছু বলেছেন কিনা? ১৯৭১ এ ভারতে আশ্রয় নেয়া এই বাঙালি শরাণার্থী শিবিরের মানুষ আরেকটি নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাই উচ্চারণ করতো, সে নামটি সিনেটর কেনেডি। যিনি এসে পাইপের ভেতর থাকা শরণার্থী শিশুর পাশে গিয়েছিলেন। এবং বার বার তার প্রেস কনফারেন্সে এসেছিলো শরনার্থীদের স্বাস্থ্য ও রোগমুক্তির বিষয়টি। কেনেডি পরিবারের প্রতি সব দেশের মানুষের একটা আলাদা শ্রদ্ধা সব সময়ই। যে কারণে এবার কেনেডি পরিবারের সদস্যকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়ে দ্বায়িত্ব নিতে দেখে মনে পড়ে যায়, ১৯৭১ এ লবন হ্রদের(যা বর্তমানে সল্ট লেক ও নিউ টাউন নামে পরিচিত) সেই শরনার্থী ক্যাম্পে সিনেটর কেনেডিকে পাইপের মধ্যে দেখার স্মৃতি।
ইন্দিরা গান্ধী যেমন সেদিন মাতৃজ্ঞানে স্মরণ হতেন, তার নাম উচ্চারণ করতে গেলে সকলে একটা শ্রদ্ধা মূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন, কেনেডির নাম উচ্চারিত হলে যেমন শ্রদ্ধা জানাতো- তেমনি এর পাশাপাশি শরনার্থী শিবিরে আরেকটি নামের প্রতি শুধু হতাশা নয়, অনেক ক্ষোভ জমা হয়েছিলো। আর এই ক্ষোভ থেকে শরণার্থী শিবিরে তার নামের আগে দুটো শব্দে’র যে কোন একটি কেউ না কেউ যোগ করতেন। তিনি উথান্ট, সে সময়ের জাতিসংঘের মহাসচিব(তখনও “মহাসচিব” এই বাংলা পরিভাষাটি চালু হয়নি) তাই তখন বলা হতো জাতিসংঘের সেক্রেটারি। কিন্তু সকলেই এই ভদ্র লোকের নাম উচ্চারণ করতে গেলে তাকে “বধির উথান্ট” বা “অন্ধ উথান্ট” বলতেন।
কারণ, সে সময়ে প্রতিদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেমন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিলো তেমনি প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু ও বৃদ্ধ মারা যাচ্ছিলো- প্রতিকূল জীবন যাপন, খাদ্য, চিকিত্সা ও পরিচর্যার অভাবে। এই মৃত্যু ও হত্যা উথান্টকে কোনরূপ নাড়া দিতে পারেনি। তার বিবেক, তার সিস্টেম কোন কিছুই সেদিন এই হত্যা ও মৃত্যুতে নড়ে ওঠেনি। সেদিন বাংলাদেশের এই বর্বোরচিত নরহত্যাকে জাতিসংঘ মানবাধকিার লঙ্ঘনও বলেনি, ইয়াহিয়া খানকে এর হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে দায়ীও করেনি – আর জেনোসাইড বলা তো দূরে থাকুক।
বরং একটা পর্যায়ে গিয়ে এই জাতিসংঘ বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে। পাকিস্তানের কাছে তখনও পূর্বখন্ড, আর আমাদের বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ সরকার যখন মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে – পাকিস্তানের যখন তাদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে- সে সময়ে পাকিস্তান চীনের মাধ্যমে বার বার জাতিসংঘে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের বিরতির প্রস্তাব আনে। কারন, যুদ্ধ বিরতি হলেই পাকিস্তান আবার শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। অথচ বাংলাদেশ- ভারত মিত্র বাহিনী সে সময়ে বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেদিন চীনের এ প্রস্তাবের পক্ষে পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যকেও জোগাড় করে ফেলেছিলো। কিন্তু প্রতিবারই তাদের প্রস্তাব পাশে ভেটো দেয় সে সময়ের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আর তার মাত্র কয়েকদিন পরে পাকিস্তান তার ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পন করে। দেশ বিদেশের সাংবাদিকরা তখন বাংলাদেশে এসে কেবলই লাখ লাখ মানুষের মৃতদেহ, কঙ্কাল আর ধর্ষিতা মা বোন কে দেখতে পায়। সেদিনের বিশ্ব মিডিয়াতে কয়েক দিন ধরেই এই গণহত্যার ছবিসহ সংবাদই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। তবে তারপরেও অন্ধ, বধির উথাণ্ট ও তার জাতিসংঘ এখানে কোন গণহত্যা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখিনি।
তবে বাঙালিও আর এর পরে জাতিসংঘ নিয়ে মাথা ঘামায়নি খুব বেশি। কারণ ১৯৭১ এর বিজয়ের মধ্যদিয়ে বাঙালি বুঝতে পারে, বাস্তবে জাতিসংঘ একটি নখ-দন্তহীন বাঘ। একটি বিশেষ গোষ্টির স্বার্থে এদের মানবাধিকারসহ সব কিছুই। আর যে কোন বড় রাষ্ট্রীয় শক্তি একে উপেক্ষাও যেমন করতে পারে তেমনি তার পক্ষে ব্যবহারও করতে পারে।
তবু্ও আজো শরণার্থী শিবিরের সেই দিনগুলো, একাত্তরের বন্দী শিবিরের দিনগুলো মনে হলে মনে পড়ে উথান্ট ও জাতিসংঘের কথা। আবার যখন কেউ কেউ ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জাতিসংঘের তদন্তের স্ট্যার্ন্ডাড নিয়ে জ্ঞান দেন, তখনও হাসি পায়, নিজ দেশের একাত্তরের মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘ কি করেছিলো তা নিয়ে তো কোন দিন এঁরা কোন কথা বলে না?
তবে এ সব নিয়ে ভাবার থেকে জীবনের এ প্রান্তে এসে বেশি তাড়া করে শরণার্থী শিবিরের সেই দিনগুলো আর বন্দী শিবিরের মূহূর্তগুলো।
লেখক, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World .
Leave a Reply