আর্কাদি গাইদার
প্রথম পরিচ্ছেদ
অন্ধকারের মধ্যে লোকের নাকডাকার আওয়াজ, কাশির শব্দ আর গা-হাত-পা চুলকনোর ঘস্ঘসানি কানে আসছিল। ওপরের বাস্কে যারা জায়গা পেয়েছিল, তারা ঘুমোচ্ছিল। আর গাড়ির মেঝের ওপর গাদাগাদি করে বসে ছিল যারা সেই সব অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানরা অনবরত গুতোগুতি করছিল আর নিচে থেকে কেবলই গুন্নুনি, বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ আর গালিগালাজের আওয়াজ কানে আসছিল।
‘আঃ, ঠেলচ কেন বাপু? বলি, মতলবথানা কী তোমার? আমারে ক্যাঁথা থেকে ঠেলে ফেলি দেবে নাকি? হংশিয়ার, নইলে তোমারে ঠেলে এক্কেবারে ফেলে দেব কিন্তু, হাঁ।’ একটা হে’ড়ে গলা গজগজ করে উঠল।
এবার শোনা গেল একটা সরু মেয়েলি গলার চিল-চ্যাঁচানি: ‘দ্যাখো, দ্যাখো, শয়তানটার কাণ্ড! আমার মুখের ওপর বুটসূদ্ধ ঠ্যাঙুদুটো সপাটে তুলে দিয়েচে। নাবাও, নাবাও বলচি, চুলোয় যাও তুমি!’
জ্বলন্ত দেশালাই-কাঠির আলোয় জমাট-বাঁধা নড়ন্ত বুটজুতো, কাঁথা, টুকুরি, টুপি আর হাত-পায়ের স্তূপ চোখে পড়ল। তারপর আলো নিবে গেলে আরও ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল সবকিছু। এক কোণে কে একজন বিষণ্ণ, বৈচিত্র্যহীন সুরে তার দুঃখের জীবনের একঘেয়ে কাহিনী একটানা বলে চলেছিল। যে লোকটি সহানুভূতি জানাচ্ছিল সে ঘন ঘন সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে গো-মাছিতে কামড়ানো ঘোড়ার মতো গাড়িটা শিউরে-শিউরে উঠছিল আর ঝাঁকি দিতে-দিতে লাইন ধরে এগোচ্ছিল।
সঙ্গীদের মধ্যে কেউ আমার জামার হাতা ধরে টান দেয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকাতেই বুঝতে পারলুম খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা, শরীর-জুড়নো হাওয়া এসে আমার ঘর্মাক্ত মুখে বাতাস করছে। ট্রেনটা আস্তে-আস্তে যাচ্ছিল, বোধহয় চড়াই ভাঙছিল। দেখি, আগুনের আভায় গোটা দিগন্ত আলো হয়ে আছে। আর তার ওপরের আকাশে, যেন ওই প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ডের উত্তাপে ঝলসে গিয়েই, তারাগুলো মিয়োনো জোনাকির মতো মিটমিট করছে, ফ্যাকাশে চাঁদ গলে মিশে গেছে আকাশে।
‘সারা তল্লাট জুড়ে বিদ্রোহ দেখা দিয়েচে,’ গাড়ির একটা অন্ধকার কোণ থেকে কার যেন শান্ত, খুশিখুশি গলা শোনা গেল।