সারাক্ষণ রিপোর্ট
গণঅভ্যুত্থান ও মায়া সরকারের পতনের পর ঢাকা শহরের ফুটপাতে চাঁদাবাজির প্রথা কিছুদিন নিস্তব্ধ থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় হকাররা ফুটপাত ও রাজপথে বেড়াচ্ছে, কিছু এলাকায় চাঁদের পরিমাণ বেড়েছে এবং নতুন চাঁদাবাজদেরও দেখা যাচ্ছে।
১. রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব
- নতুন নেতৃত্বের আগমন:
অনেক এলাকায় পূর্বের জনতা লীগী প্রতিনিধিদের পরিবর্তে এখন ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতাদের নাম চাঁদাবাজির তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
- দায়িত্বের বিন্যাসে পরিবর্তন:
শীর্ষ অপরাধীদের দায়িত্ব নির্ধারণের পাশাপাশি কিছু এলাকায় লাইনম্যানের দায়িত্ব পাল্টে গেছে।
- পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ:
পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পূর্বের তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে।

২. অতীতের প্রচেষ্টা বনাম বর্তমান বাস্তবতা
- প্রাক্তন উদ্যোগ:
২০১৬ সালের অক্টোবরে গুলিস্তান থেকে হকার মুক্ত করার প্রচেষ্টায় তৎকালীন মেয়র রফিক বিপকে পড়েন। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার মেয়র তন্ময় রাস্তায় রঙিন মার্কিং চালু করেন, তবে তা তেমন কার্যকর হয় না।
- বর্তমান চিত্র:
গণঅভ্যুত্থানের পর সাময়িকভাবে যৌথ বাহিনী অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করলেও, হকাররা পুনরায় বিভিন্ন পণ্যের দোকান বসিয়ে নিয়েছে।
৩. চাঁদার পরিমাণ ও গবেষণা ফলাফল
- নক্ষত্র ইনস্টিটিউট (২০১৬):
দুইটি সিটি করপোরেশনের ৪৩০ কিলোমিটার রাস্তায় ৩ লক্ষেরও বেশি হকার কাজ করে, যেখানে বার্ষিক চাঁদাবাজির পরিমাণ প্রায় ১৮২৫ কোটি টাকা।
(প্রতিটি হকারকে দৈনিক ৫০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়)
- রশিদ বিশ্ববিদ্যালয় (২০২০):
গড়ে প্রতিটি হকার ১৯২ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে।

৪. নিউমার্কেট ও আশেপাশের এলাকায় নতুন শাসন
- নিয়ন্ত্রণে করিম:
আজিমপুর, ইডেন কলেজ, নীলক্ষেত, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড ও কাঁটাবনসহ এলাকায় প্রায় ৭-৮ হাজার দোকানের নিয়ন্ত্রণ শীর্ষ অপরাধী করিমের হাতে রয়েছে।
- ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মুক্তির পর করিম আড়ালে থেকে সবকিছু দেখভাল করছেন।
- কিছু মার্কেটে পুরোনো দোকানি সরিয়ে নতুন দোকান বসাতে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা চার্জ নেওয়া হচ্ছে।
- পূর্বের জনতা লীগী নেতাদের জায়গায় এখন ন্যাশনাল কংগ্রেস ও যুবদলের নতুন দলের আগমন ঘটেছে।
- দোকানদারদের অভিজ্ঞতা:
এক ফল ব্যবসায়ী বলেন, “করিমের ভয় দেখিয়ে আমার কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়; দিতে ব্যর্থ হলে আমার দোকান তুলে দিয়ে নতুন দোকান বসানো হয়েছে।”
অন্য এক কাপড় দোকানি জানান, “আগে জনতা লীগী কর্মকর্তাদের চাঁদা দিতে হতো, এখন ন্যাশনাল কংগ্রেসের কাছেই মাসে প্রায় ২ হাজার টাকা দিতে হয়।”

৫. গুলিস্তানে নতুন নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ
- নতুন লাইনম্যান ও দলের পরিবর্তন:
গোলাপ শাহ মাজার থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত পূর্বে যুবলীগের মুকুল দায়িত্বে থাকলেও, এখন ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ সাদিক নিয়ন্ত্রণে।
- চাঁদা আদায়ের পদ্ধতি:
- মুকুলের কবজায় নতুন দোকান উঠানোর অভিযোগ, যেখানে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা চার্জ নেওয়া হয়।
- পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ‘তাগুর’ নামে এক হকার থেকে টাকা আদায়ের ঘটনা ও অন্যান্য এলাকায় বিভিন্ন নেতার নামে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

৬. ফার্মগেটে ক্ষমতার নতুন বিন্যাস
- ব্যস্ত হকার সংখ্যা:
ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল থেকে তেজগাঁও কলেজ পর্যন্ত প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার হকার সক্রিয়।
- ক্ষমতা সঞ্চালন:
পূর্বে জনতা লীগী কাউন্সিলর মোঃ রাকিব ও যুবলীগের মোঃ শফিক ও মোঃ আতিক এই এলাকায় কাজ করতেন।
গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক কাউন্সিলর মোঃ আবদুল্লাহ ও শীর্ষ অপরাধী আসলাম রাহমান ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
৫ আগস্টের পর আসলাম রাহমান ও বড় সাইফ ফার্মগেটে বিভিন্ন মার্কেটে অবস্থান গ্রহণ করে চাঁদা আদায় করছেন।
৭. মতিঝিলে ফ্যান্সি রাশেদের প্রভাব
- নিয়ন্ত্রণের ধারা:
মতিঝিল ব্যাংকপাড়ার ফুটপাত বর্তমানে শীর্ষ অপরাধী মোঃ নিশাত (ফ্যান্সি রাশেদ) এর নিয়ন্ত্রণে।
২০২৩ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই তিনি এই এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
- চাঁদা আদায়ের পরিসীমা:
বিভিন্ন স্থানে দোকান থেকে ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়।
শ্রমিক দলের নেতা ও হকার ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিনিধিও নিয়মিত এই কাজে জড়িত।

৮. মিরপুরে সমবায় সমিতির মাধ্যমে চাঁদাবাজি
- সমিতির কার্যক্রম:
মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় একটি সমবায় সমিতির নামে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
৫ আগস্টের পর সমিতির বইয়ে ঠিকানা স্পষ্ট না থাকলেও, ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা মোঃ হুমায়ুন ও মোঃ ফারহাদ সহ কয়েকজন লাইনম্যান কাজ করছেন।
- অতিরিক্ত কার্যক্রম:
মিরপুর ১ নম্বর ফুটপাতে সহস্রাধিক দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে, যেখানে মোঃ রিয়াজ, মোঃ জাহিদ, মোঃ সাইম, মোঃ কামাল ও মোঃ শামিম সক্রিয়।
৯. সদরঘাটে চাঁদাবাজির পরিবর্তিত চিত্র
- ব্যাপক প্রভাব:
সদরঘাট থেকে রায়সাহেব বাজার, ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত প্রায় ৩,০০০ দোকান থেকে ২০০ থেকে ১,০০০ টাকার চাঁদা আদায় করা হয়।

- নেতৃত্বের পরিবর্তন:
পূর্বে স্থানীয় জনতা লীগী নেতাদের আশ্রয়ে লাইনম্যান মোঃ ফিরোজ থাকতেন, কিন্তু বর্তমানে ন্যাশনাল কংগ্রেস ও কলেজ ছাত্রদলের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি চালু।
- দোকানদারদের অভিযোগ:
কিছু দোকানদার জানান, “অভ্যুত্থানের পর ভাবছিলাম চাঁদাবাজি থেমে যাবে, কিন্তু মোঃ ফিরোজের লোকজন এখনো প্রতিদিন টাকা আদায় করছে।”
১০. মোহাম্মদপুরে পিচ্চি হেলালের শাসন
- নতুন নিয়ন্ত্রণ:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মোহাম্মদপুরের ফুটপাত বর্তমানে মোঃ শফিক ও মোঃ সাইফুলের হাতে চলে গেছে।

- বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম:
- বেড়িবাঁধ, আদাবর, টাউন হল, বাসস্ট্যান্ড, কলেজ গেট, লালমাটিয়া সহ বিভিন্ন স্থানে ১০০ থেকে ১,০০০ টাকার চাঁদা আদায় হয়।
- আশেপাশের এলাকায় হাসপাতালপাড়া থেকে কাঁচাবাজার, যক্ষ্মা হাসপাতাল পর্যন্ত বিভিন্ন লাইনম্যান ও নেতারা চাঁদা আদায় করেন।
- যাত্রাবাড়ী থেকে পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত ২,০০০ দোকান নিয়ন্ত্রণে নিয়ে extortion চালু রয়েছে।
১১. কারা কী বলছেন
- বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ কামাল:
“ফুটপাত মানেই টাকার খেলা; যেখানে হকার, সেখানে লাইনম্যান। গণঅভ্যুত্থানের পরও এই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ, শুধু রাজনৈতিক শক্তির বদল হয়েছে।”
- বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ ফয়সাল:
“অভ্যুত্থানের পরও ফুটপাতের নতুন দোকান বসানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য চলছে।”

- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল:
“আমরা নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ফুটপাত হকার মুক্তির অভিযানে লিপ্ত আছি।”
- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোঃ সাইফুল:
“ফুটপাতের দোকানের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; পুলিশ এখন কোনো ভাগ নিচ্ছে না। ঈদের পর আরও জোরদার অভিযান হবে।”
- ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর উপকমিশনার মোঃ আব্দুল্লাহ:
“ফুটপাত থেকে দোকান উঠানোর ক্ষেত্রে পুলিশ ও করপোরেশনের সহযোগিতা ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা সম্ভব হচ্ছে না।”
Leave a Reply