০৮:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • 54

অন্যান্য সেবাকাজ

পরদিন নরেনবাবু থানায় যাইয়া তাঁহার বাড়ির সামনে বিশেষ পুলিশের ব্যবস্থা করিলেন। এ খবর শুনিয়া আমরা আরও হাসিলাম।

অতুল এখানে-সেখানে সেবাকার্য করিত কিন্তু নিজের বাড়িতে ভাইবোনদের অসুখ-বিসুখে একবার ফিরিয়াও চাহিত না। সেবার পূজার ছুটিতে অতুলের সবগুলি ভাইবোনের জ্বর হইল। অতুলের বাবা মাত্র বাজার-খরচের কয়েক টাকা হাতে রাখিয়া পূজার সময় সমস্ত খরচ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। ভাইবোনে তাহারা অনেকগুলি। সামান্য কেরানিগিরি চাকরি করিয়া কতই-বা তিনি পাইতেন।

ছেলেদের জ্বর হইলে প্রথমে তিনি বাজার-খরচের টাকা দিয়া বার্লি পথ্য ও ঔষধ কিনিলেন। তারপর বাজার করারও পয়সা হাতে থাকে নাই। সেবার ফরিদপুরে ম্যালেরিয়া জ্বর মহামারি আকারে দেখা দিল। শ্মশানঘাটে দিবা-রাত্রি চিতার পরে চিতা জ্বলিতে লাগিল। শহরের প্রায় সকল বাড়িতেই জ্বরের রোগী। কে কাহার দিকে ফিরিয়া চায়? কে কাহাকে টাকা কর্জ দেয়? আমি সারারাত্র জাগিয়া অতুলের ভাইদের সেবা করি। আমাদের একটি ভিটায় বেগুনক্ষেত করা হইয়াছিল। সেখানে হইতে বেগুন তুলিয়া আনিয়া তাহাদের দেই। সেই বেগুনের একমাত্র তরকারি আর ভাত জ্বরের রোগীদের পথ্য। বার্লি কিনিবারও পয়সা নাই। অতুল এখানে-সেখানে ঘুরিয়া বেড়ায়। অসুস্থ ভাইবোনদের দিকে ফিরিয়াও চাহে না।

ইতিমধ্যে অতুলেরও ম্যালেরিয়া জ্বর হইল। বিছানায় জ্বরের ঘোরে কাঁপিতে কাঁপিতে সে থিয়েটারের য়্যাক্ট করিত।

অঙুলের একটি ভাইয়ের জ্বর খুব বেশি হইল। উত্তাপ একশত ছয় ডিগ্রি। তখন ডাক্তার ডাকিয়া আনার প্রয়োজন। কিন্তু ডাক্তারের ফি আর ঔষধের টাকা কোথা হইতে আসিবে? রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাইতে লাগিল। ছেলেটি আমার বড়ই আদরের ছিল।

অতুলদের বাড়ি গেলে জসীমদা বলিয়া প্রাণ ভরিয়া তুলিত। আমি তার মাথায় জল-পট্টি দেই আর চোখের পানি সংবরণ করি। অতুলের মা-বাবা পার্শ্বে বসিয়া। আমার কেবলই মনে হইতেছে, ডাক্তার-ডাক্তার-একজন ডাক্তার যদি আসিত, একফোঁটা ঔষধ যদি দিত, খোকা ভালো হইয়া উঠিত। কিন্তু আমার হাতে একটি পয়সা নাই। আমি কেবলি খোকার মাথায় জল-পট্টি দিয়া পাখার বাতাস করি আর আল্লাকে ডাকি, আল্লা এই খোকাকে ভালো করিয়া দাও। কিন্তু আল্লা আমার কথা শুনিলেন না। বেলা পাঁচটার সময় খোকা চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইল।

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৫)

১১:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫

অন্যান্য সেবাকাজ

পরদিন নরেনবাবু থানায় যাইয়া তাঁহার বাড়ির সামনে বিশেষ পুলিশের ব্যবস্থা করিলেন। এ খবর শুনিয়া আমরা আরও হাসিলাম।

অতুল এখানে-সেখানে সেবাকার্য করিত কিন্তু নিজের বাড়িতে ভাইবোনদের অসুখ-বিসুখে একবার ফিরিয়াও চাহিত না। সেবার পূজার ছুটিতে অতুলের সবগুলি ভাইবোনের জ্বর হইল। অতুলের বাবা মাত্র বাজার-খরচের কয়েক টাকা হাতে রাখিয়া পূজার সময় সমস্ত খরচ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। ভাইবোনে তাহারা অনেকগুলি। সামান্য কেরানিগিরি চাকরি করিয়া কতই-বা তিনি পাইতেন।

ছেলেদের জ্বর হইলে প্রথমে তিনি বাজার-খরচের টাকা দিয়া বার্লি পথ্য ও ঔষধ কিনিলেন। তারপর বাজার করারও পয়সা হাতে থাকে নাই। সেবার ফরিদপুরে ম্যালেরিয়া জ্বর মহামারি আকারে দেখা দিল। শ্মশানঘাটে দিবা-রাত্রি চিতার পরে চিতা জ্বলিতে লাগিল। শহরের প্রায় সকল বাড়িতেই জ্বরের রোগী। কে কাহার দিকে ফিরিয়া চায়? কে কাহাকে টাকা কর্জ দেয়? আমি সারারাত্র জাগিয়া অতুলের ভাইদের সেবা করি। আমাদের একটি ভিটায় বেগুনক্ষেত করা হইয়াছিল। সেখানে হইতে বেগুন তুলিয়া আনিয়া তাহাদের দেই। সেই বেগুনের একমাত্র তরকারি আর ভাত জ্বরের রোগীদের পথ্য। বার্লি কিনিবারও পয়সা নাই। অতুল এখানে-সেখানে ঘুরিয়া বেড়ায়। অসুস্থ ভাইবোনদের দিকে ফিরিয়াও চাহে না।

ইতিমধ্যে অতুলেরও ম্যালেরিয়া জ্বর হইল। বিছানায় জ্বরের ঘোরে কাঁপিতে কাঁপিতে সে থিয়েটারের য়্যাক্ট করিত।

অঙুলের একটি ভাইয়ের জ্বর খুব বেশি হইল। উত্তাপ একশত ছয় ডিগ্রি। তখন ডাক্তার ডাকিয়া আনার প্রয়োজন। কিন্তু ডাক্তারের ফি আর ঔষধের টাকা কোথা হইতে আসিবে? রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাইতে লাগিল। ছেলেটি আমার বড়ই আদরের ছিল।

অতুলদের বাড়ি গেলে জসীমদা বলিয়া প্রাণ ভরিয়া তুলিত। আমি তার মাথায় জল-পট্টি দেই আর চোখের পানি সংবরণ করি। অতুলের মা-বাবা পার্শ্বে বসিয়া। আমার কেবলই মনে হইতেছে, ডাক্তার-ডাক্তার-একজন ডাক্তার যদি আসিত, একফোঁটা ঔষধ যদি দিত, খোকা ভালো হইয়া উঠিত। কিন্তু আমার হাতে একটি পয়সা নাই। আমি কেবলি খোকার মাথায় জল-পট্টি দিয়া পাখার বাতাস করি আর আল্লাকে ডাকি, আল্লা এই খোকাকে ভালো করিয়া দাও। কিন্তু আল্লা আমার কথা শুনিলেন না। বেলা পাঁচটার সময় খোকা চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইল।

 

চলবে…..