সারাক্ষণ রিপোর্ট
আপনি যদি পৃথিবীর বর্তমানে পরিচিত ১১,২৭৬ প্রজাতির পাখিকে স্বীকৃতির ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে রাখেন, ভারতীয় ময়ূরের জায়গা নিশ্চিতভাবেই শীর্ষ দশের মধ্যে থাকবে। প্রকৃতিতে এদের পাওয়া যায় প্রধানত ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এবং শ্রীলঙ্কায়। তবে ইউরোপ, অ্যান্টিপোডস, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এদের সেইসব অঞ্চলেও দেখা পেতে বেশি দূর যেতে হয় না। বিশেষ করে পুরুষ ময়ূরের বর্ণাঢ্য সাজসজ্জা ও চোখধাঁধানো প্রদর্শনী তো কোথাও না কোথাও চোখে পড়বেই।
ভারতীয় ময়ূর (পিকক) ও ময়ূরী (পিহেন) স্পষ্টভাবে যৌন দ্বিবর্ণতা প্রদর্শন করে। পুরুষ ময়ূরের ঝকঝকে নীল মাথা ও গলায় ছোট্ট ঝুঁটি রয়েছে, তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে এর দীর্ঘ লেজ যা পশ্চাতদেশ থেকে প্রায় এক মিটার বাড়তি প্রসারিত থাকে। ময়ূর সাধারণত তিন বছর বয়সে যৌন পরিপক্বতায় পৌঁছলে এই লেজ পুরোপুরি বিকশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এগুলি লেজের উপরিভাগের ঢাকনা পালক (upper tail coverts), যাতে অসংখ্য রঙিন চোখের মতো দাগ থাকে এবং প্রতিটি পালকের শেষাংশ মাছের লেজের মতো আকৃতির। বিশালাকার লেজ সত্ত্বেও ময়ূর উড়তে পারে, যদিও সাধারণত দিনের শেষে উঁচু গাছে আশ্রয় নেওয়ার সময়েই ওরা উড়ে ওঠে।
অপরদিকে, ময়ূরীরা এতটা আড়ম্বরপূর্ণ নয়—তাদের পালক প্রধানত বাদামি রঙের হয়। ডিম ফোটানো ও ছানাদের বড় করার সময় এই মিশে-থাকা বাদামি রং তাদের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে আত্মরক্ষায় সহায়তা করে।
ভারতীয় ময়ূর বিভিন্ন ধরনের পরিবেশে বাস করে, যেমন পাতাঝরা বন, ঝোপঝাড় ও তৃণভূমি। এরা সর্বভুক এবং সাধারণত মাটিতে বিচরণ করে বীজ, ফল, পোকামাকড়, ছোট সরীসৃপ ও বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য খেয়ে থাকে। কৃষিভিত্তিক অঞ্চলে বসবাসের কারণে অনেক সময় এরা অর্ধ-গৃহপালিত অবস্থায়ও দেখা যায়।
প্রচণ্ড গরমের সময় বা খাবার অনুসন্ধানের ফাঁকে সাধারণত ময়ূররা দলবদ্ধভাবে থাকে—অথবা কেবল পুরুষ বা কেবল স্ত্রী পাখিদের আলাদা দল গঠন করে। তবে প্রজনন ঋতু শুরু হলে এই বিন্যাস পাল্টে যায়, পুরুষ ও স্ত্রী পাখি মিলিত হয় এবং পুরুষরা লেকিং সাইট (lekking site) নামে পরিচিত নির্দিষ্ট স্থানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এখানে প্রথমে তারা একে অন্যের সামনে প্রদর্শনী করে, তবে আসল প্রচেষ্টার ঝলক দেখা যায় যখন কোনও ময়ূরী সেখানে উপস্থিত হয়।
ময়ূরী এলে পুরুষেরা সঙ্গে সঙ্গেই লেজ বিশালাকার পাখার মতো মেলে ধরে। এছাড়া তারা শরীরকে এমনভাবে সূর্যের দিকে সামান্য কাত করে রাখে, যাতে তাদের উজ্জ্বল নীল মাথা-গলা আর রঙিন লেজ সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে উজ্জ্বল দেখায়। এর পর সবচেয়ে নাটকীয় অংশটি ঘটে—তারা লেজ পাখনাগুলোকে জোরে ঝাঁকায় বা কাঁপায়, যা দূর থেকে দুর্দান্ত এক মোহময় প্রভাব তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু দেহিক সক্ষম পুরুষরাই দীর্ঘ ও ভারী লেজ বজায় রাখতে পারে; ফলে বড় ও চমকপ্রদ লেজ তাদের সুস্থতার পরিচায়ক, যা প্রজননে সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ায়। অন্য এক গবেষণায় পুরুষের লেজ নাড়া দেওয়ার সময় ময়ূরীদের চোখের দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দূর থেকে স্ত্রী পাখিরা লেজের উপরের অংশে বেশি নজর দেয়, আর কাছে এলে লেজের নিচের অংশেই মনোযোগ নিবদ্ধ করে। পুরুষেরা লেজ ঝাঁকানোর মাধ্যমে ময়ূরীর মনোযোগ ধরে রাখে, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য পুরুষরা সুযোগ না পায়।
এমনকি চার্লস ডারউইন তার যৌন নির্বাচনের তত্ত্ব বোঝাতে ময়ূরকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। সহজ কথায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনে পুরুষ পাখিকে কেবল বেঁচে থাকলেই হয় না, তাকে বংশবিস্তারের জন্য সঙ্গীও খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষমতা থাকে মূলত ময়ূরীদের হাতে, তাই পুরুষেরা ক্রমে আরও বড় এবং আরও চমকপ্রদ লেজধারী হয়ে ওঠে যদিও এটি শিকারির কবলে পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তবু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে জিন বহন করে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় পুরুষ ময়ূর এমন বিপদ মাথায় নিয়ে এই বিশালায়তন লেজ গড়ে তোলে। আর এ কারণেই এই পাখি তার স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বহু জায়গায় এত সম্মান ও বিস্ময়ের পাত্র হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply