মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫৮ অপরাহ্ন

আমাজনে হারিয়ে যাওয়া মানব ইতিহাস উন্মোচনে লিডার প্রযুক্তির সাফল্য

  • Update Time : বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ৫.৪৮ এএম

সারাক্ষণ রিপোর্ট

পুরনো রহস্যের সন্ধানে

ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের প্রত্যন্ত জঙ্গলে ১৮ শতকের এক পর্তুগিজ দুর্গ ঘিরে গড়ে ওঠা উপনিবেশ ছিল বহু বছর ধরে ইতিহাসবিদ ও পুরাতত্ত্ববিদদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সেই দুর্গের অস্তিত্ব ১৯১৩ সালে শনাক্ত হলেও, উপনিবেশের বাকি অংশ কোথায়, তা রহস্যই রয়ে গিয়েছিল।

অবশেষে লিডার (LiDAR) নামে একটি অত্যাধুনিক লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই হারিয়ে যাওয়া উপনিবেশের চিহ্ন আবারও খুঁজে পেয়েছেন ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব রোনডোনিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদ কার্লোস জিম্পেল নেতো ও তার দল।

প্রযুক্তি বদলাচ্ছে ইতিহাসের পাঠ

লিডার হলো এমন এক প্রযুক্তি যা ড্রোন বা বিমান থেকে জঙ্গলের গাছপালার ওপর দিয়ে লেজার রশ্মি ছুড়ে নিচের ভূমির সুনির্দিষ্ট চিত্র তুলে ধরে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা গাছের পাতার স্তর ভেদ করে প্রাচীন অবকাঠামো ও বসতি খুঁজে পাচ্ছেন।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে:

  • ব্রাজিলে পাওয়া গেছে উপনিবেশিক সড়ক, ক্যানাল, দুর্গ ও গির্জার ধ্বংসাবশেষ।
  • বলিভিয়ায় ৭০ ফুট উঁচু পিরামিড ও উন্নত জল ব্যবস্থাপনার প্রমাণ মিলেছে।
  • ইকুয়েডরে সন্ধান পাওয়া গেছে প্রাচীন মায়া সভ্যতার মতো কাঠামো।

আমাজনের ভূমিতে সভ্যতার নতুন ব্যাখ্যা

এতদিন ধারণা করা হতো আমাজনের মৃত্তিকা কৃষিভিত্তিক জটিল সমাজ গড়ার উপযোগী নয়। কিন্তু লিডার প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ মিলছে, বহু শতাব্দী আগে থেকেই সেখানে উন্নত নগর ব্যবস্থা ছিল, যা দীর্ঘকাল গাছপালায় আচ্ছাদিত ছিল বলে চোখে পড়েনি।

কার্লোস জিম্পেল বলেন, “এটা আমাদের ইতিহাস পুনর্লিখনের সময়।”

লেমেগো নগরীর ধ্বংসাবশেষ

জিম্পেল ও তার দল লিডার-নির্ভর ডিজিটাল মানচিত্রের সাহায্যে জঙ্গলের ভেতরে পৌঁছে লেমেগো নামক হারিয়ে যাওয়া নগরীর চিহ্ন খুঁজে পান। সেখানেই ছিল:

  • পর্তুগিজ গির্জার ভিত্তি

  • ১২০০–২০০০ বছর আগের আদিবাসীদের তৈরি সিরামিক
  • বড় বড় পাথরের ঘর ও ভূগর্ভস্থ কাঠামো

এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে, পর্তুগিজ আগমনের অনেক আগেই এখানে উন্নত আদিবাসী সভ্যতা ছিল।

ল্যাবিরিন্থ’—এক বিস্ময়ের আবিষ্কার

২০১৬ সালে পর্যটক হিসেবে দুর্গ দেখতে গিয়ে জিম্পেলের সঙ্গে পরিচয় হয় কুইলোম্বো গ্রামের নেতা এলভিস পেসোয়ার। তিনি জানান, আশেপাশের জঙ্গলে আরও কিছু রহস্যময় কাঠামো রয়েছে, যাকে স্থানীয়রা ডাকে “ল্যাবিরিন্থ” নামে।

জিম্পেল প্রথমে সন্দিহান হলেও সেখানে গিয়ে দেখতে পান:

  • ১৫ ফুট উঁচু পাথরের দেয়াল
  • প্রাচীন দরজার খিলান
  • একটি আয়তাকার ভিত্তি

এগুলো দেখে তিনি নিশ্চিত হন—এটাই সেই হারিয়ে যাওয়া পর্তুগিজ উপনিবেশ।

গবেষণার পেছনের মানুষ ও সংগ্রাম

২০২২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে “অ্যামাজন রিভিল্ড” প্রকল্পের আওতায় লিডার ব্যবহার শুরু হয়। ২০২৩ সালে পেসোয়ার মৃত্যুর পর তার ভাই সান্তিয়াগো এই কাজ চালিয়ে যান।

এদিকে স্থানীয় মানুষজন, যারা একসময় দাস হিসেবে এই দুর্গ নির্মাণে বাধ্য হয়েছিল, তাদের উত্তরসূরিরা আজও ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

আগুনের হুমকিতে ইতিহাস

এই অঞ্চলের বনাঞ্চল ‘ডিফরেস্টেশন আর্ক’ নামে পরিচিত, যেখানে বন উজাড়ের হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ভয়াবহ আগুনে ৮০ শতাংশ বন পুড়ে যায়।

জিম্পেল জানুয়ারি মাসে আবারও জঙ্গলে যান, আগুনের পর কী রয়ে গেছে তা দেখতে। ক্ষয়ক্ষতি অনেক হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এখনো অক্ষত রয়েছে।

নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায়

দলটি একটি বিশাল পাথরের কাঠামো খুঁজে পায়, যা এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় কাঠামোগুলোর একটি। জিম্পেল বলেন, “এখানে আরও বহু ঘরবাড়ি আছে, যা আমরা কল্পনাও করিনি।”

মশার কামড় আর কাদামাখা পথ পেরিয়ে তিনি আবারও হারিয়ে যান জঙ্গলের গহীনে, ইতিহাসের আরও কিছু নিদর্শনের খোঁজে।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024