ভারতের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল, সোমবার তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বলে পুলিশ দাবি করে। তবে পুলিশের দাবির পরেই সোমবারই জাফরাবাদ এলাকায় নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
আবার দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভাঙ্গরেও ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বিক্ষোভকারীদের। সেখানেও পুলিশের গাড়ি জ্বালানো হয়েছে, পুলিশও পাল্টা লাঠি চালিয়েছে।
তবে মুর্শিদাবাদের ঘটনা কীভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের রূপ নিল, সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে সামনে উঠে আসছে।
প্রথম দফায় গত মঙ্গল ও বুধবার এবং দ্বিতীয় দফায় শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী সুতি ও সামশেরগঞ্জ এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়েছিল।
এর মধ্যে শনিবার স্পষ্টতই ওই সহিংসতা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের চেহারা নেয়। সেদিন তিনজনের মৃ্ত্যু হয়েছিল – যাদের দুজন হিন্দু ও একজন মুসলমান। রাজ্য পুলিশ এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সেদিন রাত থেকেই সুতি ও সামশেরগঞ্জ থানা এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ যৌথভাবে টহল দিচ্ছে।
রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশক (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যে ওই দুটি থানা এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সোমবার সকাল থেকেই বিভিন্ন দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছিলেন বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান রভি গান্ধীও। তিনি বলেছেন রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে সীমান্ত-রক্ষীরাও টহল দিচ্ছেন।
হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ২০০-এরও বেশি মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ থেকে মালদায় পালিয়ে গিয়েছেন প্রায় ৪০০ জনের মতো মানুষ, এদের বেশিরভাগই হিন্দু বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
মালদায় পালিয়েছেন সামশেরগঞ্জের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক মনিরুল ইসলামও। ঘরছাড়া ১৭টি পরিবারকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলন বদলে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়
গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিরল
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একরকম অতি বিরল।
এতদিন দেখা গেছে হিন্দু-মুসলমান যতই বিরোধিতা থাক, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব থাক, সে সবই শহর বা শহর লাগোয়া অঞ্চলেই হয়ে থাকে। নিজেদের জীবন জীবিকার কারণেই গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ তাই দেখাই যায়নি বিশেষ।
তবে শনিবারের ঘটনা আর রবিবার সকালে মুর্শিদাবাদ থেকে যে তথ্য আর ছবি পাওয়া গেছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে গ্রামাঞ্চলের সেই সৌহার্দ্যে বড়সড় চিড় ধরেছে, অন্তত ওই একটি অঞ্চলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য বলছেন, “গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা দাঙ্গা হয়েছে, প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই তা হয়েছে শহর বা শহর লাগোয়া এলাকায়। গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সাধারণত দেখা যায়নি।”
“এবারই দেখছি মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ এলাকাতেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে গেল। কারা ঘটালো, কীভাবে ঘটল সেটা তো পুলিশের কাজ খুঁজে বের করা। কিন্তু অন্যান্য ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি গোড়ার দিকে পুলিশ-প্রশাসন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থামাতে কিছুটা সময় নিলেও রাতের দিকে বা একদিনেই পরিস্থিতি সামলিয়ে নেয়। এবারেই দেখলাম দিন পাঁচেক সময় লেগে গেল পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ এলাকা থেকে বহু হিন্দু পরিবার পার্শ্ববর্তী জেলা মালদা বা পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে চলে গেছেন। যদিও সোমবার তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিবার ফিরে এসেছেন।
তবে কাদের ভয়ে তারা পালিয়েছিলেন তারা? গ্রামেরই প্রতিবেশী? না কি শনিবার যারা দাঙ্গা বাঁধালো, সেই অনেক ‘অপরিচিত মুখ’?
বাইরে থেকে কোনও সংগঠন বা কিছু ব্যক্তি এসে কি গ্রামীণ এলাকার এই সম্প্রীতির আবহাওয়ায় চিড় ধরালো – যেমনটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন রাজ্যের মুসলমান নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও?
মুর্শিদাবাদের অন্তত ৪০০ জন পালিয়ে গিয়ে পাশের জেলা মালদায় আশ্রয় নিয়েছেন
ওয়াকফ-বিরোধী প্রতিবাদ ধাক্কা খাবে?
কারা কীভাবে মুর্শিদাবাদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বদলে দিল, তার চিত্রটা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান নেতৃত্বের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে তারা একটা কথা সবাই স্বীকার করছেন, শনিবার যে ঘটনা হয়েছে, তা সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে চলমান আন্দোলনকে ধাক্কা দেবে।
রাজ্য সরকারের মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যারা এটা করছেন, তারা সাবধান হয়ে যান। আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করছেন।
“পুলিশের সঙ্গে পেটাপেটি করছেন, আগুন লাগাচ্ছেন; এতে করে কি ওয়াকফ আইনের কালা কানুনটা রদ হবে?” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. চৌধুরী।
তিনি আরও বলছিলেন, “শুনছি কারা নাকি জিহাদের জন্য ফতোয়া জারি করে দিয়েছে ওখানে! কারা এরা? কোথায় পড়াশোনা করেছে? দারুল উল উলুম দেওবন্ধ বলুন বা অন্য যে কোনও ইসলামি সেমিনারি থেকে পড়ে এলে এসব কথা বলতে পারে না কেউ।”
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সভাপতি মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলছেন, “এই আন্দোলন তো হিন্দু ভাইদের বিরুদ্ধে ছিল না! এটা তো কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সেখান থেকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে নিল ঘটনাটা, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
“তবে এক্ষেত্রে আমি বলল তৃণমূল কংগ্রেসের যে মুর্শিদাবাদের স্থানীয় নেতৃত্ব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাদের ওপরেও কিছুটা দায় বর্তায়। মানুষের এই উত্তেজনা থামাতে ইমামদের নামাতে গেল কেন? উচিত ছিল শাসকদলের জনপ্রতিনিধিদের রাস্তায় নামানো,” বলছিলেন মি. কামরুজ্জামান।
গ্রামে গ্রামে চলছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশের যৌথ টহল
প্রেক্ষাপট তৈরিই হচ্ছিল?
আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন। তার বছর খানেক আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে নানা রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন ধর্মীয় মেরুকরণের একটা চেষ্টা এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে।
মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বলছিলেন, “দেখে তো মনে হচ্ছে মমতা ব্যানার্জীর সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই ভিন রাজ্যের কিছু সংগঠন, কয়েকটি নাম আমার কাছে এসেছে যা এখনই প্রকাশ করব না, তারাই এসে এই সহিংসতায় ইন্ধন দিয়েছে। কেরলের একটি সংগঠনের সঙ্গে এদের যোগ আছে বলে জেনেছি, মুর্শিদাবাদে তাদের সংগঠন খুলেছে। ভোটেও দাঁড়ায় তারা, জিততে পারে না।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল সরকার বলছিলেন, “গত কয়েক মাস ধরেই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছিল। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার কিছু আলোচনা যদি শোনেন, মনে হবে না এটা রাজ্যের আইনসভার আলোচনা, মনে হবে ধর্ম সংসদ চলছে। কার কী জাত, কে কোন ধর্মের এইসব নিয়ে নেতারা আলোচনা করলেন।
“আর বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে এটা আরও বেশি করে হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এক বিধায়ক বলছেন সেখানে তিনি বাবরি মসজিদ তৈরি করবেন, পাল্টা বিজেপি বলেছে রাম-মন্দির বানাবে। মানে, একটা ধর্মীয় বিদ্বেষের আবহ তৈরিই ছিল,” বলছিলেন মি. সরকার।
এছাড়াও নির্বাচনের আগে থেকেই স্থানীয় স্তরে কে প্রার্থী হতে পারেন, তার একটা সম্ভাব্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
মি. সরকার মনে করছেন মুর্শিদাবাদের ঘটনাবলীতে সেই অশুভ প্রতিযোগিতার ছায়াও দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচন যত এগোবে, এই ধর্মীয় মেরুকরণের আরও নানা প্রচেষ্টাও চলবে বলে মনে করছেন তিনি।
বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা
Leave a Reply