সারাক্ষণ রিপোর্ট
নিরাপদ ডলার এখন আতঙ্কের উৎস
একসময় যে ডলার ছিল নিরাপত্তার প্রতীক, এখন তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডলারের মান বড় মুদ্রাগুলোর তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি কমেছে। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই দুই-পঞ্চমাংশ পতন ঘটেছে, যদিও দশ বছর মেয়াদি আমেরিকান ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ০.২ শতাংশ বেড়েছে। এই অসঙ্গতি—সুদের হার বাড়লেও বিনিয়োগকারীদের পিছু হটা—এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা আমেরিকাকে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির স্তম্ভে ফাটল
দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকান সম্পদগুলিকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করা হতো। ট্রেজারি বন্ডের বিশাল বাজার, ডলারের আধিপত্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে এই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে।
ট্রাম্পের নীতিতে অস্থিরতা এবং আস্থা সংকট
ট্রাম্পের বেপরোয়া বাণিজ্য যুদ্ধ আমদানি শুল্ক দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে সরবরাহ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে একসময়ের প্রশংসিত মার্কিন অর্থনীতি এখন মন্দার মুখোমুখি।
ঋণ ও ঘাটতির বিস্ফোরণ
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ বর্তমানে জিডিপির ১০০ শতাংশের কাছাকাছি। বাজেট ঘাটতি গত বছর ছিল ৭ শতাংশ—যা একটি শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য অস্বাভাবিক। তবুও, কংগ্রেস আরও ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সম্প্রতি গৃহীত বাজেট পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী এক দশকে ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ঘাটতি যোগ হবে। এটি শুধু প্রথম দফার ট্রাম্প কর ছাড়, কোভিড-১৯ খরচ এবং বাইডেনের প্রণোদনা প্যাকেজের সম্মিলিত পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যাবে।
প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা বিনিয়োগকারীদের আস্থার ক্ষয় করছে
ট্রাম্প প্রশাসনের বেহাল নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া—বারবার শুল্ক ঘোষণা ও স্থগিতকরণ, বিভাজনমূলক আইন, এবং অনিশ্চিত অর্থনৈতিক বার্তা—বাজারকে সংকটে ফেলেছে। কিছু হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা এমনকি ডলারকে ‘ভার’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ফেডারেল রিজার্ভ চাপে, বাজার অনিশ্চয়তায়
ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভকে সুদের হার কমাতে চাপ দিচ্ছেন এবং ২০২৬ সালে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। তার প্রশাসনের বিতর্কিত কার্যক্রম যেমন অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নির্বাসন এবং বিরোধী আইনজীবীদের হয়রানি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করছে।
আমেরিকান সম্পদের জন্য ঝুঁকির প্রিমিয়াম
বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সরকারি ঋণের মালিক, যার অর্ধেকের বেশি বেসরকারি খাতে। আগামী বছরে সরকারকে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার পুনঃঋণ নিতে হবে। যদি ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা কমে, তাহলে বাজেট ঘাটতি আরও প্রকট হবে।
সংকটে কংগ্রেস কী করবে?
গত মহামন্দা ও মহামারিতে কংগ্রেস ব্যয় বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু এবার প্রয়োজন হবে ব্যয় কমানো এবং কর বাড়ানোর। বর্তমান কংগ্রেস ও প্রশাসনের গঠন বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাজারকে হয়তো প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
ফেডারেল রিজার্ভের কঠিন সিদ্ধান্ত
ফেড চাইলেই বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে অব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দিতে চায় না। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ফেডকে সমর্থন না করে বরং বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সাহায্য করার বিরোধিতা করতে পারেন।
বিশ্বব্যবস্থার জন্য ডলারের পতন এক বিপর্যয়
ডলার এখনো বিশ্বের প্রধান মুদ্রা। ইউরোর পেছনে বড় অর্থনীতি থাকলেও নিরাপদ সম্পদের অভাব, সুইজারল্যান্ড ছোট, জাপানের নিজস্ব ঋণ সমস্যা, আর সোনা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির নেই রাষ্ট্রীয় সহায়তা। ডলারের বিকল্প নেই বললেই চলে।
উপসংহার: একটি অজানা ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আর্থিক অপশাসন যদি চলতে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যবস্থা একবারে ভেঙে পড়তে পারে। ডলারের ক্ষমতা হ্রাস পেলে আমেরিকানদের পুঁজি সংগ্রহ ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, যার প্রভাব পড়বে ছোট বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বড় কর্পোরেশন পর্যন্ত। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ভিত্তি চরম অনিশ্চয়তায় পড়বে।