সারাক্ষণ রিপোর্ট
দেশবরেণ্য সঙ্গীত গবেষক, শিল্পী, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই। ২০২৫ সালের ১০ মে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটের দিকে ঢাকার বনানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বার্ধক্যজনিত জটিলতা ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর কন্যা শারমিন আব্বাসী এ মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।
শৈশব ও সঙ্গীত উত্তরাধিকার
১৯৩৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের বলরামপুরে জন্ম মোস্তাফা জামান আব্বাসীর। তিনি বাংলা লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁর বড় বোন ফেরদৌসী রহমান একজন খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী এবং বড় ভাই বিচারপতি মোস্তাফা কামাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
গভীর সঙ্গীতচর্চার পরিবেশে বেড়ে ওঠা আব্বাসী প্রথাগত তালিম নেন উস্তাদ আব্দুল গফুর খান ও উস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দিন খানের কাছে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবন ও অবদান
মোস্তাফা জামান আব্বাসীর পেশাজীবন ছয় দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। তিনি সঙ্গীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন।
- সঙ্গীত গবেষণা ও সংগ্রহ:
বাংলার লোকসঙ্গীতকে সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ গান সংগ্রহ ও গবেষণা করেন। লালন শাহসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ধারার হাজার হাজার গান সংরক্ষণে ভূমিকা রাখেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত। - গ্রন্থ রচনা:
৬০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ: মানুষ ও শিল্পী’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: মানুষ ও কবি’, এবং ‘ভাতের দেশের ভাটিয়ালি’, যেখানে ৬০০টিরও বেশি গান সুরলিপি ও বিশ্লেষণসহ সংকলিত হয়েছে। - টেলিভিশন ও রেডিও:
‘আমার ঠিকানা’, ‘লৌকিক বাংলা’ এবং ‘ভরা নদীর বাঁকে’ প্রভৃতি জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি লোকসঙ্গীত ও সংস্কৃতি বিষয়ে দর্শকদের অবহিত করেন। - প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব:
তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীন আহমদ গবেষণা কেন্দ্র’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। এছাড়া ইউনেস্কোর আওতায় বাংলাদেশ জাতীয় সঙ্গীত কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন একটানা ১১ বছর।
পুরস্কার ও সম্মাননা
মোস্তাফা জামান আব্বাসী তাঁর অনন্য অবদানের জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে রয়েছে:
- একুশে পদক (১৯৯৫)
- নজরুল মেলা আজীবন সম্মাননা
- অ্যাপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার
- নাট্যসভা পুরস্কার
- বেঙ্গল শতবার্ষিকী সম্মাননা
- আব্বাসউদ্দীন স্বর্ণপদক
- মানিক মিয়া পদক
- সিলেট সঙ্গীত পুরস্কার
- লালন পরিষদ সম্মাননা
ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার
মোস্তাফা জামান আব্বাসী’র স্ত্রী আসমা আব্বাসী একজন শিক্ষাবিদ ও লেখক। তাঁদের দুই কন্যা— সামিরা আব্বাসী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গীত গবেষক ও শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন এবং শারমিনি আব্বাসী, একজন আইনজীবী ও লেখক।
মোস্তাফা জামান আব্বাসীর প্রয়াণে বাংলা সঙ্গীত ও সংস্কৃতির এক মহারথীর যাত্রা শেষ হলো। তাঁর সংগ্রহ, গবেষণা ও চর্চার মাধ্যমে তিনি বাংলা লোকসঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন এক অমূল্য সাংস্কৃতিক ধনভাণ্ডার। তাঁর অবদান জাতির ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।