০৫:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

গ্রিনল্যান্ডের বরফচাদরের নিচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নিউক্লিয়ার সামরিক ঘাঁটি

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০০:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • 40

নেইল শে ও ম্যাট গ্রিফিন

১৯৬০ সালের অক্টোবরের এক হিমশীতল দিনে বিশ্বের শীর্ষে, গ্রিনল্যান্ডের বরফের গভীরে একদল মার্কিন সেনা প্রযুক্তিবিদ একটি পারমাণবিক চুল্লি চালু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এটি ছিল একটি পরীক্ষামূলক, ছোট ও অস্থির রিঅ্যাক্টর—তখনো পারমাণবিক শক্তির যুগ নতুন। চারপাশে জমাট বরফের দেয়াল তাদের কণ্ঠরোধ করছিল, আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল বরফে, আর গাইগার কাউন্টারের শব্দ নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছিল।

রিঅ্যাক্টরের প্রতিক্রিয়া শুরু হতেই কন্ট্রোল রুমে হয়তো উল্লাসের চাপা শব্দ উঠেছিল, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই সেটি বন্ধ করার জন্য দৌঁড়ায়। বরফের গভীরে কোথাও রেডিওঅ্যাকটিভ নিউট্রনের লিকেজ ধরা পড়ে।

এই ঘাঁটির নাম ছিল ‘ক্যাম্প সেঞ্চুরি’। এটি জনসম্মুখে আমেরিকান প্রকৌশল দক্ষতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল—বরফের নিচে একটি পরিপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা, যেখানে ২০০ সেনা বসবাস করতে পারত। কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গোপন। ডেনমার্ক সরকারের অজ্ঞাতসারে এটি ছিল ‘প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম’ নামের এক পরিকল্পনার অংশ, যেখানে ধারণা করা হয়েছিল বরফের নিচে রেলপথ বসিয়ে ৬০০ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করা যাবে। লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে।

 

ঘাঁটির বাস্তবতা

ক্যাম্প সেঞ্চুরি ছিল থুলে বিমানঘাঁটি থেকে ১২৭ মাইল দূরে। সেনারা বরফের উপর দিয়ে ট্রেনে (সুইং) যেতো, যা ভালো আবহাওয়ায়ও দীর্ঘ সময় লাগত। খারাপ আবহাওয়ায় যাত্রা ছিল ভয়ানক।

অস্টিন কোভাকস নামে এক সেনা প্রকৌশলী তখন ঘাঁটিতে কাজ করতেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বিপজ্জনক ভাবা হলেও আসলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল একঘেয়েমি।”

সেনারা বরফের নিচে তৈরি ট্রেঞ্চে বসবাস করত। কোভাকস ‘ট্রেঞ্চ ৩৩’–এ বড় ভবনের জন্য ভিত্তি নিয়ে গবেষণা করতেন। সেখানে সূর্যের আলো ছিল না, পাখির কিচিরমিচির ছিল না। বিনোদনের জন্য ছিল সিনেমা, একটি ছোট লাইব্রেরি এবং স্লেজ কুকুর ‘মুকলুক’।

বরফের নিচে বিজ্ঞান

সেনারা বরফের নিচে একটি কূপ খনন করছিল, যার গভীরতা ছিল ৪ হাজার ফুট। এরপর তারা বরফচাদরের নিচে জমাট মাটি উত্তোলন করে—১১.৫ ফুট লম্বা। সেই মাটির মধ্যেই ছিল পাতা, গুল্ম, কীটপতঙ্গের নমুনা—যা প্রমাণ করে বরফের নিচে একসময় ছিল সবুজ ভূমি।

এই মাটির নমুনা দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্ক ও পরে ডেনমার্কে জমা ছিল। ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্টের পল বিয়ারম্যান ও তার সহকর্মীরা এই নমুনা বিশ্লেষণ করে এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে পৌঁছান—গ্রিনল্যান্ড এক সময় বরফমুক্ত ছিল, এবং সেখানে ছিল গাছপালা ও প্রাণের অস্তিত্ব। সময়কাল আনুমানিক ৪ লাখ বছর আগের, যখন পৃথিবী আজকের তুলনায় উষ্ণ ছিল।

ভবিষ্যতের বার্তা

এই আবিষ্কার বোঝায় যে গ্রিনল্যান্ডের বরফ চাদর অতীতের তুলনায় নতুন এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় এটি গলে গিয়ে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু করে দিতে পারে। এতে উপকূলীয় শহর ও কৃষিজমি প্লাবিত হবে, এবং কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে।

বিয়ারম্যান বলেন, “মানুষ ভাবে ‘ওটা তো আর্কটিক, আমার কি?’ কিন্তু ১৯৬৬ সালের সেই মাটি আজকের বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।”

প্রকল্পের পতন

‘প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম’ ব্যর্থ হয় বরফের স্বাভাবিক গতি ও অস্থিরতাকে অবমূল্যায়ন করার কারণে। বরফ সরে, বাড়ে, সংকুচিত হয়—যা স্থায়ী রেলপথ বা স্থাপনার পক্ষে অনুকূল নয়। ১৯৬৩ সালে রিঅ্যাক্টর বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ১৯৬৬ সালে ঘাঁটি পরিত্যক্ত হয়।

 

কোভাকস ১৯৬৯ সালে ফিরে গিয়ে ধ্বংসস্তূপ দেখেন। ছবি তুলে রাখেন—বরফ টানেল গিলে নিচ্ছে, ধাতব কাঠামো ভেঙে পড়ছে, কাঠের বিমগুলো ভেঙে গেছে।

বিজ্ঞানই চূড়ান্ত উত্তরাধিকার

দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর ক্যাম্প সেঞ্চুরির প্রকৃত উত্তরাধিকার হিসেবে থেকে গেছে সেখানকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা। সেই গবেষণাই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশা দিচ্ছে।

বিয়ারম্যান বলেন, “ভাবুন, ১৯৬৬ সালে যারা বরফ খুঁড়ছিল, তারা জানত না কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু তারা থামেনি।”

লেখক নেইল শে ২০০৮ সাল থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর নিয়মিত লেখক এবং আর্কটিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে বসবাস করেন।

গ্রিনল্যান্ডের বরফচাদরের নিচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নিউক্লিয়ার সামরিক ঘাঁটি

০৭:০০:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

নেইল শে ও ম্যাট গ্রিফিন

১৯৬০ সালের অক্টোবরের এক হিমশীতল দিনে বিশ্বের শীর্ষে, গ্রিনল্যান্ডের বরফের গভীরে একদল মার্কিন সেনা প্রযুক্তিবিদ একটি পারমাণবিক চুল্লি চালু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এটি ছিল একটি পরীক্ষামূলক, ছোট ও অস্থির রিঅ্যাক্টর—তখনো পারমাণবিক শক্তির যুগ নতুন। চারপাশে জমাট বরফের দেয়াল তাদের কণ্ঠরোধ করছিল, আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল বরফে, আর গাইগার কাউন্টারের শব্দ নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছিল।

রিঅ্যাক্টরের প্রতিক্রিয়া শুরু হতেই কন্ট্রোল রুমে হয়তো উল্লাসের চাপা শব্দ উঠেছিল, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই সেটি বন্ধ করার জন্য দৌঁড়ায়। বরফের গভীরে কোথাও রেডিওঅ্যাকটিভ নিউট্রনের লিকেজ ধরা পড়ে।

এই ঘাঁটির নাম ছিল ‘ক্যাম্প সেঞ্চুরি’। এটি জনসম্মুখে আমেরিকান প্রকৌশল দক্ষতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল—বরফের নিচে একটি পরিপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা, যেখানে ২০০ সেনা বসবাস করতে পারত। কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গোপন। ডেনমার্ক সরকারের অজ্ঞাতসারে এটি ছিল ‘প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম’ নামের এক পরিকল্পনার অংশ, যেখানে ধারণা করা হয়েছিল বরফের নিচে রেলপথ বসিয়ে ৬০০ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করা যাবে। লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে।

 

ঘাঁটির বাস্তবতা

ক্যাম্প সেঞ্চুরি ছিল থুলে বিমানঘাঁটি থেকে ১২৭ মাইল দূরে। সেনারা বরফের উপর দিয়ে ট্রেনে (সুইং) যেতো, যা ভালো আবহাওয়ায়ও দীর্ঘ সময় লাগত। খারাপ আবহাওয়ায় যাত্রা ছিল ভয়ানক।

অস্টিন কোভাকস নামে এক সেনা প্রকৌশলী তখন ঘাঁটিতে কাজ করতেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বিপজ্জনক ভাবা হলেও আসলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল একঘেয়েমি।”

সেনারা বরফের নিচে তৈরি ট্রেঞ্চে বসবাস করত। কোভাকস ‘ট্রেঞ্চ ৩৩’–এ বড় ভবনের জন্য ভিত্তি নিয়ে গবেষণা করতেন। সেখানে সূর্যের আলো ছিল না, পাখির কিচিরমিচির ছিল না। বিনোদনের জন্য ছিল সিনেমা, একটি ছোট লাইব্রেরি এবং স্লেজ কুকুর ‘মুকলুক’।

বরফের নিচে বিজ্ঞান

সেনারা বরফের নিচে একটি কূপ খনন করছিল, যার গভীরতা ছিল ৪ হাজার ফুট। এরপর তারা বরফচাদরের নিচে জমাট মাটি উত্তোলন করে—১১.৫ ফুট লম্বা। সেই মাটির মধ্যেই ছিল পাতা, গুল্ম, কীটপতঙ্গের নমুনা—যা প্রমাণ করে বরফের নিচে একসময় ছিল সবুজ ভূমি।

এই মাটির নমুনা দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্ক ও পরে ডেনমার্কে জমা ছিল। ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্টের পল বিয়ারম্যান ও তার সহকর্মীরা এই নমুনা বিশ্লেষণ করে এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে পৌঁছান—গ্রিনল্যান্ড এক সময় বরফমুক্ত ছিল, এবং সেখানে ছিল গাছপালা ও প্রাণের অস্তিত্ব। সময়কাল আনুমানিক ৪ লাখ বছর আগের, যখন পৃথিবী আজকের তুলনায় উষ্ণ ছিল।

ভবিষ্যতের বার্তা

এই আবিষ্কার বোঝায় যে গ্রিনল্যান্ডের বরফ চাদর অতীতের তুলনায় নতুন এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় এটি গলে গিয়ে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু করে দিতে পারে। এতে উপকূলীয় শহর ও কৃষিজমি প্লাবিত হবে, এবং কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে।

বিয়ারম্যান বলেন, “মানুষ ভাবে ‘ওটা তো আর্কটিক, আমার কি?’ কিন্তু ১৯৬৬ সালের সেই মাটি আজকের বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।”

প্রকল্পের পতন

‘প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম’ ব্যর্থ হয় বরফের স্বাভাবিক গতি ও অস্থিরতাকে অবমূল্যায়ন করার কারণে। বরফ সরে, বাড়ে, সংকুচিত হয়—যা স্থায়ী রেলপথ বা স্থাপনার পক্ষে অনুকূল নয়। ১৯৬৩ সালে রিঅ্যাক্টর বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ১৯৬৬ সালে ঘাঁটি পরিত্যক্ত হয়।

 

কোভাকস ১৯৬৯ সালে ফিরে গিয়ে ধ্বংসস্তূপ দেখেন। ছবি তুলে রাখেন—বরফ টানেল গিলে নিচ্ছে, ধাতব কাঠামো ভেঙে পড়ছে, কাঠের বিমগুলো ভেঙে গেছে।

বিজ্ঞানই চূড়ান্ত উত্তরাধিকার

দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর ক্যাম্প সেঞ্চুরির প্রকৃত উত্তরাধিকার হিসেবে থেকে গেছে সেখানকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা। সেই গবেষণাই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশা দিচ্ছে।

বিয়ারম্যান বলেন, “ভাবুন, ১৯৬৬ সালে যারা বরফ খুঁড়ছিল, তারা জানত না কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু তারা থামেনি।”

লেখক নেইল শে ২০০৮ সাল থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর নিয়মিত লেখক এবং আর্কটিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে বসবাস করেন।