০৪:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

কংক্রিটের সমুদ্রপ্রাচীর কীভাবে জাপানের একটি দ্বীপগ্রামকে দ্বিধাবিভক্ত করল

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • 44

রনাল্ড রদ্রিগেস ও কাওরি কোহিয়ামা

দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ আমামি ওওশিমায় সামনের দিনে যে বিশাল কংক্রিটের সমুদ্রপ্রাচীর উঠতে চলেছেতা দ্বীপের বাসিন্দা ও পরিবেশবিদ‑দুপক্ষকেই ভাবিয়ে তুলেছে। সমুদ্রতীর রক্ষার আর কোনও পথ কি নেই?

জুলাই ২০২২‑এর ভোরবেলাগ্রীষ্মের শান্ত সকালেহিসামি তাকে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন আমামি ওওশিমার কাটোকু সমুদ্রতীরে। বালুর ওপর তিনি দেখেন একটি জীবের পায়ের ছাপসমুদ্র থেকে উঠে এসে আবার জলের দিকেই মোড় নিয়েছে। তাঁর ধারণাবিলুপ্তির মুখে থাকা লগারহেড প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে এসে শেষমেশ ফিরে গেছে। এ বছর একটা ডিমও পাওয়া যায়নি। মনে হয়উজ্জ্বল কমলা দড়িটার ঝিলিক কচ্ছপদের ফিরিয়ে দিচ্ছে,” বলেন ৪৯‑বছরের এই দ্বীপবাসী।

তাকে‑সহ দ্বীপের আরও অনেকেই আশঙ্কা করেনদড়ির জায়গায় যে বিশাল কংক্রিটের প্রাচীর তোলা হবেতা কচ্ছপের মতো বিপন্ন প্রাণীদের সমুদ্রতীরে ওঠার পথ রোধ করবে। নির্মাণকোম্পানি ও কাগোশিমা প্রশাসন এ বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

গত কয়েক বছর ধরে চলা প্রকল্পটি দ্বীপের মানুষজনকেই দুভাগে ভাগ করেছে। বিজ্ঞানী ও বহু স্থানীয়ের মতেকংক্রিটের এই প্রাচীর দ্বীপের হুমকির মুখে থাকা বন্যপ্রাণকে অপরিবর্তনীয়ভাবে ঠেকিয়ে দেবেতাঁদের পরামর্শস্থানীয় গাছ লাগিয়ে স্বভাবিক উপায়ে বালুচর রক্ষা করাই দূরদর্শী সমাধান। অন্যদিকেসমুদ্রপ্রাচীরপন্থীরা মনে করেনউপকূলভূমি ও বসতিকে ঘূর্ণিঝড়‑সৃষ্ট ক্ষয় থেকে বাঁচাতে এটা প্রয়োজনীয়একে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো‑উন্নয়ন হিসেবেই দেখছেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় জনপদগুলো কীভাবে সাড়া দেবেএই বিতর্ক তারই প্রতিচ্ছবি। কঠোর প্রতিরক্ষা‑ব্যবস্থা হিসেবে কংক্রিটের সি‑ওয়াল কয়েক দশক ধরে নানা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছেতবে এখন অনেক বিজ্ঞানী পরিবেশমুখী প্রাকৃতিক পন্থাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুই পন্থা যখন মুখোমুখিজয়ী হয় কোনটি?

দ্বীপের শেষ অবাধ বয়ে চলা কাটোকু নদীখাত ও তীরবর্তী সাদা বালুর গর্ব নিয়ে পরিচিত আমামি ওওশিমাজাপানের মোট ভূমির মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ হলেও এখানে ৯৫টি বিশ্ব-হুমকিগ্রস্ত প্রজাতিযার ৭৫টিই স্থানীয়আর উদ্ভিদের সংখ্যাই ১,৮০০‑এর বেশি। ২০২১‑এর জুলাইয়ে পাশের তিনটি দ্বীপের অংশবিশেষ‑সহ এ দ্বীপকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান দেওয়া হয়।

এ রকম স্বর্গীয় জায়গা আমামিতেই আছেএ কথা ভাবতে পারিনি,” স্মৃতিচারণ করেন তাকে। বাচ্চা বেলায় আসল’ সমুদ্রতীর দেখিনিবাকি সব তীর আর নদী কংক্রিটে বাঁধানো। শুধু কাটোকুতে এখনো উন্মুক্ত বালুচরনদীমুখ আর চলমান বালিয়াড়ি আছে।

কিন্তু এখন কাগোশিমা প্রশাসন ১৮০ মিটার দীর্ঘ ও ৬.৫ মিটার উঁচু প্রাচীর তুলছেযুক্তি—“ঘূর্ণিঝড়‑জনিত ক্ষয় থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য।” বৈশ্বিক ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা ও সমুদ্র‑উন্নতির প্রেক্ষাপটেএমন দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতেও বারবার দেখা দেবে।

২০১৪‑র দুটি ঝড়ে বালু ক্ষয়ের ভয়ে স্থানীয়রা সেতাউচি টাউন কাউন্সিলে পদক্ষেপ চাইলেসমাধান হিসেবে সি‑ওয়াল চাওয়া হয়নি। তবু ২০১৮‑তে প্রকল্প অনুমোদন পায়। এরই মধ্যে অন্য বাসিন্দারা বিরোধিতা করে জানানপ্রাচীর কাটোকু নদীকে ব্যাহত করে বিরল তীরতন্ত্র নষ্ট করবে। ২০২০‑তে ৩০,০০০‑এর বেশি স্বাক্ষরে নির্মাণ পুনর্বিবেচনার দাবি জানানো হয়কিন্তু প্রশাসনের সাড়া মেলেনি।

২০২১‑এ আইইউসিএন কাটোকু নদী ও পাশের সমুদ্রতীরকে বাফার জোন’ ঘোষণা করে আইনি সুরক্ষার আওতায় এনেছে। তবু ২০২২‑এর ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রতিবাদে স্থগিত থেকেছে২০২৪‑এর জুলাইয়ে আবার গতি পায়। প্রাচীরবিরোধী মামলা এখনো জাপানের সুপ্রিম কোর্টে চলমানবাদী জেলফ ও দ্বীপবাসীর অভিযোগজনধন অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ। কাগোশিমা প্রশাসন পাল্টা যুক্তি দিয়েছেঝড়জলে ক্ষয় ঠেকাতে এটি অপরিহার্যসব আইনি প্রক্রিয়া মানা হয়েছে।

পরিবর্তনশীল বালু

পরিবেশসমীক্ষায় শুরুতে দেখানো দূরত্ব বজায় না রেখে প্রাচীরটি নদীমুখের কাছেই তোলা হচ্ছে বলে আশঙ্কা। টোকিও‑ভিত্তিক কস্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরির ২০২৪‑এর বিশ্লেষণও বলছেপ্রাচীর আসলে কাটোকু নদীর মূল চ্যানেলের মধ্যেই। বছরের ছয় মাস নদীমুখ ও বালুচর সরে এই অংশে পৌঁছেফলে প্রাচীর নদীর স্বাভাবিক গতিপথবালুবাহিত প্রক্রিয়া ও পূর্ণ তীরতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে ইউনেসকোর পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর দাবি উঠেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ২০১৬‑১৮‑র প্রশাসনিক সমীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ‑বৈঠকে গ্রামের মানুষের মতই নেওয়া হয়নিআগের গ্রামপ্রধান ছাড়া কাউকে ডাকাই হয়নি। বর্তমান গ্রামপ্রধান শিগেও সাকায়ে (দায়িত্বে ২০২৩‑এর এপ্রিলে) খুঁটিনাটি জানতেন না বলেই জানান। তিনি বলেনসামগ্রিক দ্বীপে কেবল কাটোকুতেই এখনো কোনো কঠোর উপকূল‑কাঠামো ছিল না।

সেতাউচি টাউনের মেয়র কামাতা নারুহিতো বলেনদ্বীপের বিশ্বঐতিহ্য মর্যাদা অটুট রাখতে হবেসঙ্গে কেন্দ্রীয় সহায়তায় পাবলিক ওয়ার্কস’-ও দরকারযা অর্থনীতিকে চাঙা করবে।

কংক্রিটের মূল্য

ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা বেড়ে ও সমুদ্র‑স্তর বাড়তে থাকায়উপকূল উন্নয়নে কোন পথ বেছে নেবে মানুষআইপিসিসির ২০১৯‑এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেসমুদ্রতীর রক্ষা করতে বাঁধসি‑ওয়ালসর্জবারিয়ার ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃতএগুলো নিরাপত্তা নির্ধারিত মাত্রায় নিশ্চয়তা দেয়। তবে কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑বিশেষজ্ঞ সাতোকো সেইনোর মন্তব্যকংক্রিট প্রাচীর নির্মাণ ব্যয়বহুলরক্ষণাবেক্ষণও চিরস্থায়ী খরচের বোঝা।

আস পাশের কমিনাতো সমুদ্রতীরে ১৯৭০‑এর পর কয়েক দশকে ৫.৩২ বিলিয়ন ইয়েনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির পর এখন পরিত্যক্ত কংক্রিটের স্তুপ দেখা যায়বালুচর সংকুচিতও হয়েছে। ২০২১‑এ ইকোস্ট মেরিন কনসাল্টিংয়ের এডওয়ার্ড অ্যাটকিনের সমীক্ষায় দেখা যায়কমিনাতোর সি‑ওয়াল বালুক্ষয় বাড়িয়েছেনিজেও সাগরের তোড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত।

২০০০‑এর দশক থেকে বিশেষত ইউরোপ‑উত্তর আমেরিকায় উপকূল‑ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিনির্ভর সমাধানে ঝুঁকছেন বিশেষজ্ঞরাবালিয়াড়িম্যানগ্রোভ ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ কাজে লাগানোকে আইপিসিসি টেকসই পন্থা বলে মান্যতা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নোয়াও লিভিং শোরলাইনস’—সবুজ অবকাঠামোব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছেগবেষণা বলছেঝড়জলে এসব বাঁধ রক্ষা‑ক্ষমতায় কখনও কংক্রিটকে ছাপিয়ে যায়একই সঙ্গে পুষ্টিদূষণ শোষণ ও মাছের আবাস গড়ে তোলে।

জাপানের সীকোস্ট আইনে ১৯৯৯‑এর সংশোধনী টেকসই উপকূল‑পরিকল্পনা চাইলেও অগ্রগতি ধীর। ২০১8‑এ পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইকো‑ডিআরআর’ (ইকোসিস্টেম‑ভিত্তিক দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস) কৌশল সামনে আনে। সরকার ২০১৯‑এ আইইউসিএন‑কে চিঠিতে লেখেকাটোকু তীরে প্রকৃতিবান্ধব’ সি‑ওয়াল বানিয়ে তাতে বালু ও গাছ চাপা দেওয়া হবে। তবে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑গবেষক ও পুনরুদ্ধারকর্মী ওয়েসলি ক্রাইলের অভিমত—“শব্দটা সুন্দরকিন্তু কাজ চলে না।” তাঁর মতেকাটোকু‑ও হাওয়াইয়ের মাউই দ্বীপের মতোস্থানীয় গাছপ্যান্ডানাসমর্নিং গ্লোরিবালু ধরে বালিয়াড়ি গড়ে তোলে। ঝড়ে বালু সরে গেলেওঝড় থামলেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ফের গড়ে ওঠে।

সেইনোর কথায়, “বালিয়াড়ি সুস্থ থাকলে সেটাই প্রাকৃতিক সি‑ওয়াল হিসেবে কাজ করে।” ২০১৫‑থেকে দ্বীপবাসী‑স্বেচ্ছাসেবীদের অতন্দ্র তদারকিতে প্যান্ডানাস ও মর্নিং গ্লোরি লাগিয়ে বালু রক্ষা করা হচ্ছে। ৯০‑বছরের বাসিন্দা হিরোআকি সানো জানালেনগোরস্থানের সামনের অংশ এখন প্যান্ডানাসে ঘনআগের তীব্র ক্ষয় উধাও। তবে দীর্ঘমেয়াদি বালু চলাচল আরও ভালোভাবে বুঝে তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।

স্থানীয় সহযোগিতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোই প্রকৃতিনির্ভর পদক্ষেপে সাফল্যের চাবিকাঠিবললেন আমামি নেচার স্কুলের প্রধানসংরক্ষণকর্মী নাওশি নাগায়ে। তাঁর পরামর্শচারা রোপনই কার্যকরতবে সেগুলি যেন একই বা পাশের গ্রাম থেকেই আনা হয়যাতে আগাছা ঢুকে না পড়ে।

কার্বন কাউন্ট

এই প্রতিবেদন করতে যাত্রাপথে আনুমানিক ১৭০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছেঅনলাইন পাঠে প্রতিবার ১.২‑৩.৬ গ্রাম নির্গমনের সম্ভাবনা আছে।

বালু টিকিয়ে রাখার প্রকল্প বনাম কংক্রিট‑প্রাচীরএই দুই সমাধানকে ঘিরে দ্বীপবাসীর টানাপড়েন তীব্র। এটা শুধু প্রকৃতি বা জীবনমরণের প্রশ্ন নয়আমাদেরই মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে,” বললেন স্থানীয় এনজিও সেভ কাটোকুর প্রধান জঁ‑মার্ক তাকাকি। ফোকসঙ্গীতশিল্পী এরিকো মিনায়োশি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদে বসে আছেনতাঁর কথায়, “কেউ কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে নাশুধু বলে, ‘ব্যবসা আটকাচ্ছসরে দাঁড়াও।’ প্রতিদিনই মানসিক চাপ বাড়ছে।” তিনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনুভব করছেন।

তাকের দৃঢ় বিশ্বাসদ্বীপবাসী ও কর্তৃপক্ষের মুক্ত সংলাপই সত্যিকারের সমাধান দেবে। মনে মনে আমরা সবাই সমুদ্রতীরটাকে রক্ষা করতে চাইআমাদের কাটোকু সমুদ্রতীরের সবার মঙ্গলই যে আসল কথা।

কংক্রিটের সমুদ্রপ্রাচীর কীভাবে জাপানের একটি দ্বীপগ্রামকে দ্বিধাবিভক্ত করল

০৮:০০:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

রনাল্ড রদ্রিগেস ও কাওরি কোহিয়ামা

দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ আমামি ওওশিমায় সামনের দিনে যে বিশাল কংক্রিটের সমুদ্রপ্রাচীর উঠতে চলেছেতা দ্বীপের বাসিন্দা ও পরিবেশবিদ‑দুপক্ষকেই ভাবিয়ে তুলেছে। সমুদ্রতীর রক্ষার আর কোনও পথ কি নেই?

জুলাই ২০২২‑এর ভোরবেলাগ্রীষ্মের শান্ত সকালেহিসামি তাকে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন আমামি ওওশিমার কাটোকু সমুদ্রতীরে। বালুর ওপর তিনি দেখেন একটি জীবের পায়ের ছাপসমুদ্র থেকে উঠে এসে আবার জলের দিকেই মোড় নিয়েছে। তাঁর ধারণাবিলুপ্তির মুখে থাকা লগারহেড প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে এসে শেষমেশ ফিরে গেছে। এ বছর একটা ডিমও পাওয়া যায়নি। মনে হয়উজ্জ্বল কমলা দড়িটার ঝিলিক কচ্ছপদের ফিরিয়ে দিচ্ছে,” বলেন ৪৯‑বছরের এই দ্বীপবাসী।

তাকে‑সহ দ্বীপের আরও অনেকেই আশঙ্কা করেনদড়ির জায়গায় যে বিশাল কংক্রিটের প্রাচীর তোলা হবেতা কচ্ছপের মতো বিপন্ন প্রাণীদের সমুদ্রতীরে ওঠার পথ রোধ করবে। নির্মাণকোম্পানি ও কাগোশিমা প্রশাসন এ বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

গত কয়েক বছর ধরে চলা প্রকল্পটি দ্বীপের মানুষজনকেই দুভাগে ভাগ করেছে। বিজ্ঞানী ও বহু স্থানীয়ের মতেকংক্রিটের এই প্রাচীর দ্বীপের হুমকির মুখে থাকা বন্যপ্রাণকে অপরিবর্তনীয়ভাবে ঠেকিয়ে দেবেতাঁদের পরামর্শস্থানীয় গাছ লাগিয়ে স্বভাবিক উপায়ে বালুচর রক্ষা করাই দূরদর্শী সমাধান। অন্যদিকেসমুদ্রপ্রাচীরপন্থীরা মনে করেনউপকূলভূমি ও বসতিকে ঘূর্ণিঝড়‑সৃষ্ট ক্ষয় থেকে বাঁচাতে এটা প্রয়োজনীয়একে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো‑উন্নয়ন হিসেবেই দেখছেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় জনপদগুলো কীভাবে সাড়া দেবেএই বিতর্ক তারই প্রতিচ্ছবি। কঠোর প্রতিরক্ষা‑ব্যবস্থা হিসেবে কংক্রিটের সি‑ওয়াল কয়েক দশক ধরে নানা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছেতবে এখন অনেক বিজ্ঞানী পরিবেশমুখী প্রাকৃতিক পন্থাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুই পন্থা যখন মুখোমুখিজয়ী হয় কোনটি?

দ্বীপের শেষ অবাধ বয়ে চলা কাটোকু নদীখাত ও তীরবর্তী সাদা বালুর গর্ব নিয়ে পরিচিত আমামি ওওশিমাজাপানের মোট ভূমির মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ হলেও এখানে ৯৫টি বিশ্ব-হুমকিগ্রস্ত প্রজাতিযার ৭৫টিই স্থানীয়আর উদ্ভিদের সংখ্যাই ১,৮০০‑এর বেশি। ২০২১‑এর জুলাইয়ে পাশের তিনটি দ্বীপের অংশবিশেষ‑সহ এ দ্বীপকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান দেওয়া হয়।

এ রকম স্বর্গীয় জায়গা আমামিতেই আছেএ কথা ভাবতে পারিনি,” স্মৃতিচারণ করেন তাকে। বাচ্চা বেলায় আসল’ সমুদ্রতীর দেখিনিবাকি সব তীর আর নদী কংক্রিটে বাঁধানো। শুধু কাটোকুতে এখনো উন্মুক্ত বালুচরনদীমুখ আর চলমান বালিয়াড়ি আছে।

কিন্তু এখন কাগোশিমা প্রশাসন ১৮০ মিটার দীর্ঘ ও ৬.৫ মিটার উঁচু প্রাচীর তুলছেযুক্তি—“ঘূর্ণিঝড়‑জনিত ক্ষয় থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য।” বৈশ্বিক ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা ও সমুদ্র‑উন্নতির প্রেক্ষাপটেএমন দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতেও বারবার দেখা দেবে।

২০১৪‑র দুটি ঝড়ে বালু ক্ষয়ের ভয়ে স্থানীয়রা সেতাউচি টাউন কাউন্সিলে পদক্ষেপ চাইলেসমাধান হিসেবে সি‑ওয়াল চাওয়া হয়নি। তবু ২০১৮‑তে প্রকল্প অনুমোদন পায়। এরই মধ্যে অন্য বাসিন্দারা বিরোধিতা করে জানানপ্রাচীর কাটোকু নদীকে ব্যাহত করে বিরল তীরতন্ত্র নষ্ট করবে। ২০২০‑তে ৩০,০০০‑এর বেশি স্বাক্ষরে নির্মাণ পুনর্বিবেচনার দাবি জানানো হয়কিন্তু প্রশাসনের সাড়া মেলেনি।

২০২১‑এ আইইউসিএন কাটোকু নদী ও পাশের সমুদ্রতীরকে বাফার জোন’ ঘোষণা করে আইনি সুরক্ষার আওতায় এনেছে। তবু ২০২২‑এর ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রতিবাদে স্থগিত থেকেছে২০২৪‑এর জুলাইয়ে আবার গতি পায়। প্রাচীরবিরোধী মামলা এখনো জাপানের সুপ্রিম কোর্টে চলমানবাদী জেলফ ও দ্বীপবাসীর অভিযোগজনধন অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ। কাগোশিমা প্রশাসন পাল্টা যুক্তি দিয়েছেঝড়জলে ক্ষয় ঠেকাতে এটি অপরিহার্যসব আইনি প্রক্রিয়া মানা হয়েছে।

পরিবর্তনশীল বালু

পরিবেশসমীক্ষায় শুরুতে দেখানো দূরত্ব বজায় না রেখে প্রাচীরটি নদীমুখের কাছেই তোলা হচ্ছে বলে আশঙ্কা। টোকিও‑ভিত্তিক কস্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরির ২০২৪‑এর বিশ্লেষণও বলছেপ্রাচীর আসলে কাটোকু নদীর মূল চ্যানেলের মধ্যেই। বছরের ছয় মাস নদীমুখ ও বালুচর সরে এই অংশে পৌঁছেফলে প্রাচীর নদীর স্বাভাবিক গতিপথবালুবাহিত প্রক্রিয়া ও পূর্ণ তীরতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে ইউনেসকোর পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর দাবি উঠেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ২০১৬‑১৮‑র প্রশাসনিক সমীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ‑বৈঠকে গ্রামের মানুষের মতই নেওয়া হয়নিআগের গ্রামপ্রধান ছাড়া কাউকে ডাকাই হয়নি। বর্তমান গ্রামপ্রধান শিগেও সাকায়ে (দায়িত্বে ২০২৩‑এর এপ্রিলে) খুঁটিনাটি জানতেন না বলেই জানান। তিনি বলেনসামগ্রিক দ্বীপে কেবল কাটোকুতেই এখনো কোনো কঠোর উপকূল‑কাঠামো ছিল না।

সেতাউচি টাউনের মেয়র কামাতা নারুহিতো বলেনদ্বীপের বিশ্বঐতিহ্য মর্যাদা অটুট রাখতে হবেসঙ্গে কেন্দ্রীয় সহায়তায় পাবলিক ওয়ার্কস’-ও দরকারযা অর্থনীতিকে চাঙা করবে।

কংক্রিটের মূল্য

ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা বেড়ে ও সমুদ্র‑স্তর বাড়তে থাকায়উপকূল উন্নয়নে কোন পথ বেছে নেবে মানুষআইপিসিসির ২০১৯‑এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেসমুদ্রতীর রক্ষা করতে বাঁধসি‑ওয়ালসর্জবারিয়ার ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃতএগুলো নিরাপত্তা নির্ধারিত মাত্রায় নিশ্চয়তা দেয়। তবে কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑বিশেষজ্ঞ সাতোকো সেইনোর মন্তব্যকংক্রিট প্রাচীর নির্মাণ ব্যয়বহুলরক্ষণাবেক্ষণও চিরস্থায়ী খরচের বোঝা।

আস পাশের কমিনাতো সমুদ্রতীরে ১৯৭০‑এর পর কয়েক দশকে ৫.৩২ বিলিয়ন ইয়েনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির পর এখন পরিত্যক্ত কংক্রিটের স্তুপ দেখা যায়বালুচর সংকুচিতও হয়েছে। ২০২১‑এ ইকোস্ট মেরিন কনসাল্টিংয়ের এডওয়ার্ড অ্যাটকিনের সমীক্ষায় দেখা যায়কমিনাতোর সি‑ওয়াল বালুক্ষয় বাড়িয়েছেনিজেও সাগরের তোড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত।

২০০০‑এর দশক থেকে বিশেষত ইউরোপ‑উত্তর আমেরিকায় উপকূল‑ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিনির্ভর সমাধানে ঝুঁকছেন বিশেষজ্ঞরাবালিয়াড়িম্যানগ্রোভ ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ কাজে লাগানোকে আইপিসিসি টেকসই পন্থা বলে মান্যতা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নোয়াও লিভিং শোরলাইনস’—সবুজ অবকাঠামোব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছেগবেষণা বলছেঝড়জলে এসব বাঁধ রক্ষা‑ক্ষমতায় কখনও কংক্রিটকে ছাপিয়ে যায়একই সঙ্গে পুষ্টিদূষণ শোষণ ও মাছের আবাস গড়ে তোলে।

জাপানের সীকোস্ট আইনে ১৯৯৯‑এর সংশোধনী টেকসই উপকূল‑পরিকল্পনা চাইলেও অগ্রগতি ধীর। ২০১8‑এ পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইকো‑ডিআরআর’ (ইকোসিস্টেম‑ভিত্তিক দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস) কৌশল সামনে আনে। সরকার ২০১৯‑এ আইইউসিএন‑কে চিঠিতে লেখেকাটোকু তীরে প্রকৃতিবান্ধব’ সি‑ওয়াল বানিয়ে তাতে বালু ও গাছ চাপা দেওয়া হবে। তবে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑গবেষক ও পুনরুদ্ধারকর্মী ওয়েসলি ক্রাইলের অভিমত—“শব্দটা সুন্দরকিন্তু কাজ চলে না।” তাঁর মতেকাটোকু‑ও হাওয়াইয়ের মাউই দ্বীপের মতোস্থানীয় গাছপ্যান্ডানাসমর্নিং গ্লোরিবালু ধরে বালিয়াড়ি গড়ে তোলে। ঝড়ে বালু সরে গেলেওঝড় থামলেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ফের গড়ে ওঠে।

সেইনোর কথায়, “বালিয়াড়ি সুস্থ থাকলে সেটাই প্রাকৃতিক সি‑ওয়াল হিসেবে কাজ করে।” ২০১৫‑থেকে দ্বীপবাসী‑স্বেচ্ছাসেবীদের অতন্দ্র তদারকিতে প্যান্ডানাস ও মর্নিং গ্লোরি লাগিয়ে বালু রক্ষা করা হচ্ছে। ৯০‑বছরের বাসিন্দা হিরোআকি সানো জানালেনগোরস্থানের সামনের অংশ এখন প্যান্ডানাসে ঘনআগের তীব্র ক্ষয় উধাও। তবে দীর্ঘমেয়াদি বালু চলাচল আরও ভালোভাবে বুঝে তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।

স্থানীয় সহযোগিতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোই প্রকৃতিনির্ভর পদক্ষেপে সাফল্যের চাবিকাঠিবললেন আমামি নেচার স্কুলের প্রধানসংরক্ষণকর্মী নাওশি নাগায়ে। তাঁর পরামর্শচারা রোপনই কার্যকরতবে সেগুলি যেন একই বা পাশের গ্রাম থেকেই আনা হয়যাতে আগাছা ঢুকে না পড়ে।

কার্বন কাউন্ট

এই প্রতিবেদন করতে যাত্রাপথে আনুমানিক ১৭০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছেঅনলাইন পাঠে প্রতিবার ১.২‑৩.৬ গ্রাম নির্গমনের সম্ভাবনা আছে।

বালু টিকিয়ে রাখার প্রকল্প বনাম কংক্রিট‑প্রাচীরএই দুই সমাধানকে ঘিরে দ্বীপবাসীর টানাপড়েন তীব্র। এটা শুধু প্রকৃতি বা জীবনমরণের প্রশ্ন নয়আমাদেরই মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে,” বললেন স্থানীয় এনজিও সেভ কাটোকুর প্রধান জঁ‑মার্ক তাকাকি। ফোকসঙ্গীতশিল্পী এরিকো মিনায়োশি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদে বসে আছেনতাঁর কথায়, “কেউ কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে নাশুধু বলে, ‘ব্যবসা আটকাচ্ছসরে দাঁড়াও।’ প্রতিদিনই মানসিক চাপ বাড়ছে।” তিনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনুভব করছেন।

তাকের দৃঢ় বিশ্বাসদ্বীপবাসী ও কর্তৃপক্ষের মুক্ত সংলাপই সত্যিকারের সমাধান দেবে। মনে মনে আমরা সবাই সমুদ্রতীরটাকে রক্ষা করতে চাইআমাদের কাটোকু সমুদ্রতীরের সবার মঙ্গলই যে আসল কথা।