রনাল্ড রদ্রিগেস ও কাওরি কোহিয়ামা
দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ আমামি ওওশিমায় সামনের দিনে যে বিশাল কংক্রিটের সমুদ্রপ্রাচীর উঠতে চলেছে, তা দ্বীপের বাসিন্দা ও পরিবেশবিদ‑—দু’পক্ষকেই ভাবিয়ে তুলেছে। সমুদ্রতীর রক্ষার আর কোনও পথ কি নেই?
জুলাই ২০২২‑এর ভোরবেলা, গ্রীষ্মের শান্ত সকালে, হিসামি তাকে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন আমামি ওওশিমার কাটোকু সমুদ্রতীরে। বালুর ওপর তিনি দেখেন একটি জীবের পায়ের ছাপ—সমুদ্র থেকে উঠে এসে আবার জলের দিকেই মোড় নিয়েছে। তাঁর ধারণা, বিলুপ্তির মুখে থাকা লগারহেড প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে এসে শেষমেশ ফিরে গেছে। “এ বছর একটা ডিমও পাওয়া যায়নি। মনে হয়, উজ্জ্বল কমলা দড়িটার ঝিলিক কচ্ছপদের ফিরিয়ে দিচ্ছে,” বলেন ৪৯‑বছরের এই দ্বীপবাসী।
তাকে‑সহ দ্বীপের আরও অনেকেই আশঙ্কা করেন, দড়ির জায়গায় যে বিশাল কংক্রিটের প্রাচীর তোলা হবে, তা কচ্ছপের মতো বিপন্ন প্রাণীদের সমুদ্রতীরে ওঠার পথ রোধ করবে। নির্মাণ–কোম্পানি ও কাগোশিমা প্রশাসন এ বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
গত কয়েক বছর ধরে চলা প্রকল্পটি দ্বীপের মানুষজনকেই দু’ভাগে ভাগ করেছে। বিজ্ঞানী ও বহু স্থানীয়ের মতে, কংক্রিটের এই প্রাচীর দ্বীপের হুমকির মুখে থাকা বন্যপ্রাণকে অপরিবর্তনীয়ভাবে ঠেকিয়ে দেবে; তাঁদের পরামর্শ, স্থানীয় গাছ লাগিয়ে স্বভাবিক উপায়ে বালুচর রক্ষা করাই দূরদর্শী সমাধান। অন্যদিকে, সমুদ্রপ্রাচীরপন্থীরা মনে করেন, উপকূলভূমি ও বসতিকে ঘূর্ণিঝড়‑সৃষ্ট ক্ষয় থেকে বাঁচাতে এটা প্রয়োজনীয়—একে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো‑উন্নয়ন হিসেবেই দেখছেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় জনপদগুলো কীভাবে সাড়া দেবে—এই বিতর্ক তারই প্রতিচ্ছবি। কঠোর প্রতিরক্ষা‑ব্যবস্থা হিসেবে কংক্রিটের সি‑ওয়াল কয়েক দশক ধরে নানা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে এখন অনেক বিজ্ঞানী পরিবেশমুখী প্রাকৃতিক পন্থাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুই পন্থা যখন মুখোমুখি, জয়ী হয় কোনটি?
দ্বীপের শেষ অবাধ বয়ে চলা কাটোকু নদীখাত ও তীরবর্তী সাদা বালুর গর্ব নিয়ে পরিচিত আমামি ওওশিমা—জাপানের মোট ভূমির মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ হলেও এখানে ৯৫টি বিশ্ব-হুমকিগ্রস্ত প্রজাতি, যার ৭৫টিই স্থানীয়, আর উদ্ভিদের সংখ্যাই ১,৮০০‑এর বেশি। ২০২১‑এর জুলাইয়ে পাশের তিনটি দ্বীপের অংশবিশেষ‑সহ এ দ্বীপকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান দেওয়া হয়।
“এ রকম স্বর্গীয় জায়গা আমামিতেই আছে—এ কথা ভাবতে পারিনি,” স্মৃতিচারণ করেন তাকে। “বাচ্চা বেলায় ‘আসল’ সমুদ্রতীর দেখিনি—বাকি সব তীর আর নদী কংক্রিটে বাঁধানো। শুধু কাটোকুতে এখনো উন্মুক্ত বালুচর, নদীমুখ আর চলমান বালিয়াড়ি আছে।”
কিন্তু এখন কাগোশিমা প্রশাসন ১৮০ মিটার দীর্ঘ ও ৬.৫ মিটার উঁচু প্রাচীর তুলছে, যুক্তি—“ঘূর্ণিঝড়‑জনিত ক্ষয় থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য।” বৈশ্বিক ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা ও সমুদ্র‑উন্নতির প্রেক্ষাপটে, এমন দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতেও বারবার দেখা দেবে।
২০১৪‑র দুটি ঝড়ে বালু ক্ষয়ের ভয়ে স্থানীয়রা সেতাউচি টাউন কাউন্সিলে পদক্ষেপ চাইলে, সমাধান হিসেবে সি‑ওয়াল চাওয়া হয়নি। তবু ২০১৮‑তে প্রকল্প অনুমোদন পায়। এরই মধ্যে অন্য বাসিন্দারা বিরোধিতা করে জানান—প্রাচীর কাটোকু নদীকে ব্যাহত করে বিরল তীরতন্ত্র নষ্ট করবে। ২০২০‑তে ৩০,০০০‑এর বেশি স্বাক্ষরে নির্মাণ পুনর্বিবেচনার দাবি জানানো হয়, কিন্তু প্রশাসনের সাড়া মেলেনি।
২০২১‑এ আইইউসিএন কাটোকু নদী ও পাশের সমুদ্রতীরকে ‘বাফার জোন’ ঘোষণা করে আইনি সুরক্ষার আওতায় এনেছে। তবু ২০২২‑এর ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়, মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রতিবাদে স্থগিত থেকেছে, ২০২৪‑এর জুলাইয়ে আবার গতি পায়। প্রাচীরবিরোধী মামলা এখনো জাপানের সুপ্রিম কোর্টে চলমান—বাদী জেলফ ও দ্বীপবাসীর অভিযোগ, জনধন অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ। কাগোশিমা প্রশাসন পাল্টা যুক্তি দিয়েছে—ঝড়জলে ক্ষয় ঠেকাতে এটি অপরিহার্য, সব আইনি প্রক্রিয়া মানা হয়েছে।
পরিবর্তনশীল বালু
পরিবেশ–সমীক্ষায় শুরুতে দেখানো দূরত্ব বজায় না রেখে প্রাচীরটি নদীমুখের কাছেই তোলা হচ্ছে বলে আশঙ্কা। টোকিও‑ভিত্তিক কস্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরির ২০২৪‑এর বিশ্লেষণও বলছে—প্রাচীর আসলে কাটোকু নদীর মূল চ্যানেলের মধ্যেই। বছরের ছয় মাস নদীমুখ ও বালুচর সরে এই অংশে পৌঁছে, ফলে প্রাচীর নদীর স্বাভাবিক গতিপথ, বালুবাহিত প্রক্রিয়া ও পূর্ণ তীরতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে ইউনেসকোর পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর দাবি উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৬‑১৮‑র প্রশাসনিক সমীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ‑বৈঠকে গ্রামের মানুষের মতই নেওয়া হয়নি; আগের গ্রামপ্রধান ছাড়া কাউকে ডাকাই হয়নি। বর্তমান গ্রামপ্রধান শিগেও সাকায়ে (দায়িত্বে ২০২৩‑এর এপ্রিলে) খুঁটিনাটি জানতেন না বলেই জানান। তিনি বলেন, সামগ্রিক দ্বীপে কেবল কাটোকুতেই এখনো কোনো কঠোর উপকূল‑কাঠামো ছিল না।
সেতাউচি টাউনের মেয়র কামাতা নারুহিতো বলেন, দ্বীপের বিশ্বঐতিহ্য মর্যাদা অটুট রাখতে হবে—সঙ্গে কেন্দ্রীয় সহায়তায় ‘পাবলিক ওয়ার্কস’-ও দরকার, যা অর্থনীতিকে চাঙা করবে।
কংক্রিটের মূল্য
ঘূর্ণিঝড়‑তীব্রতা বেড়ে ও সমুদ্র‑স্তর বাড়তে থাকায়, উপকূল উন্নয়নে কোন পথ বেছে নেবে মানুষ? আইপিসিসির ২০১৯‑এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—সমুদ্রতীর রক্ষা করতে বাঁধ, সি‑ওয়াল, সর্জবারিয়ার ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত; এগুলো নিরাপত্তা নির্ধারিত মাত্রায় নিশ্চয়তা দেয়। তবে কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑বিশেষজ্ঞ সাতোকো সেইনোর মন্তব্য—কংক্রিট প্রাচীর নির্মাণ ব্যয়বহুল, রক্ষণাবেক্ষণও চিরস্থায়ী খরচের বোঝা।
আস পাশের কমিনাতো সমুদ্রতীরে ১৯৭০‑এর পর কয়েক দশকে ৫.৩২ বিলিয়ন ইয়েনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির পর এখন পরিত্যক্ত কংক্রিটের স্তুপ দেখা যায়, বালুচর সংকুচিতও হয়েছে। ২০২১‑এ ইকোস্ট মেরিন কনসাল্টিংয়ের এডওয়ার্ড অ্যাটকিনের সমীক্ষায় দেখা যায়—কমিনাতোর সি‑ওয়াল বালুক্ষয় বাড়িয়েছে, নিজেও সাগরের তোড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত।
২০০০‑এর দশক থেকে বিশেষত ইউরোপ‑উত্তর আমেরিকায় উপকূল‑ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিনির্ভর সমাধানে ঝুঁকছেন বিশেষজ্ঞরা—বালিয়াড়ি, ম্যানগ্রোভ ইত্যাদি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ কাজে লাগানোকে আইপিসিসি টেকসই পন্থা বলে মান্যতা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নোয়াও ‘লিভিং শোরলাইনস’—সবুজ অবকাঠামো—ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে; গবেষণা বলছে, ঝড়জলে এসব বাঁধ রক্ষা‑ক্ষমতায় কখনও কংক্রিটকে ছাপিয়ে যায়, একই সঙ্গে পুষ্টিদূষণ শোষণ ও মাছের আবাস গড়ে তোলে।
জাপানের সীকোস্ট আইনে ১৯৯৯‑এর সংশোধনী টেকসই উপকূল‑পরিকল্পনা চাইলেও অগ্রগতি ধীর। ২০১8‑এ পরিবেশ মন্ত্রণালয় ‘ইকো‑ডিআরআর’ (ইকোসিস্টেম‑ভিত্তিক দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস) কৌশল সামনে আনে। সরকার ২০১৯‑এ আইইউসিএন‑কে চিঠিতে লেখে—কাটোকু তীরে ‘প্রকৃতিবান্ধব’ সি‑ওয়াল বানিয়ে তাতে বালু ও গাছ চাপা দেওয়া হবে। তবে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল‑গবেষক ও পুনরুদ্ধারকর্মী ওয়েসলি ক্রাইলের অভিমত—“শব্দটা সুন্দর, কিন্তু কাজ চলে না।” তাঁর মতে, কাটোকু‑ও হাওয়াইয়ের মাউই দ্বীপের মতো; স্থানীয় গাছ—প্যান্ডানাস, মর্নিং গ্লোরি—বালু ধরে বালিয়াড়ি গড়ে তোলে। ঝড়ে বালু সরে গেলেও, ঝড় থামলেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ফের গড়ে ওঠে।
সেইনোর কথায়, “বালিয়াড়ি সুস্থ থাকলে সেটাই প্রাকৃতিক সি‑ওয়াল হিসেবে কাজ করে।” ২০১৫‑থেকে দ্বীপবাসী‑স্বেচ্ছাসেবীদের অতন্দ্র তদারকিতে প্যান্ডানাস ও মর্নিং গ্লোরি লাগিয়ে বালু রক্ষা করা হচ্ছে। ৯০‑বছরের বাসিন্দা হিরোআকি সানো জানালেন, গোরস্থানের সামনের অংশ এখন প্যান্ডানাসে ঘন—আগের তীব্র ক্ষয় উধাও। তবে দীর্ঘমেয়াদি বালু চলাচল আরও ভালোভাবে বুঝে তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
স্থানীয় সহযোগিতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোই প্রকৃতিনির্ভর পদক্ষেপে সাফল্যের চাবিকাঠি—বললেন আমামি নেচার স্কুলের প্রধান, সংরক্ষণকর্মী নাওশি নাগায়ে। তাঁর পরামর্শ, চারা রোপনই কার্যকর, তবে সেগুলি যেন একই বা পাশের গ্রাম থেকেই আনা হয়, যাতে আগাছা ঢুকে না পড়ে।
কার্বন কাউন্ট
এই প্রতিবেদন করতে যাত্রাপথে আনুমানিক ১৭০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছে; অনলাইন পাঠে প্রতিবার ১.২‑৩.৬ গ্রাম নির্গমনের সম্ভাবনা আছে।
বালু টিকিয়ে রাখার প্রকল্প বনাম কংক্রিট‑প্রাচীর—এই দুই সমাধানকে ঘিরে দ্বীপবাসীর টানাপড়েন তীব্র। “এটা শুধু প্রকৃতি বা জীবন–মরণের প্রশ্ন নয়, আমাদেরই মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে,” বললেন স্থানীয় এনজিও ‘সেভ কাটোকু’র প্রধান জঁ‑মার্ক তাকাকি। ফোকসঙ্গীতশিল্পী এরিকো মিনায়োশি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদে বসে আছেন; তাঁর কথায়, “কেউ কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে না—শুধু বলে, ‘ব্যবসা আটকাচ্ছ, সরে দাঁড়াও।’ প্রতিদিনই মানসিক চাপ বাড়ছে।” তিনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনুভব করছেন।
তাকের দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বীপবাসী ও কর্তৃপক্ষের মুক্ত সংলাপই সত্যিকারের সমাধান দেবে। “মনে মনে আমরা সবাই সমুদ্রতীরটাকে রক্ষা করতে চাই—আমাদের কাটোকু সমুদ্রতীরের সবার মঙ্গলই যে আসল কথা।”