মাহির আলি
কাশ্মীর কখনোই এমন এক বিষফোড়ার মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য ছিল না, যা ১৯৪৭-এর অসম্পূর্ণ কাজের দগদগে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। সে সময় এই ভূমিকায় নাম লেখায়নি, আর অধিকাংশ কাশ্মীরিই নিশ্চয়ই প্রতিবেশীদের সৃষ্ট এমন এক উন্মুক্ত ক্ষতে বাস করতে চান না।
গত মাসে পাহালগামে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বিষয়ে লেখার আগ্রহ কমে যায়, কারণ সে সন্ত্রাসী হামলা ভয়াবহ হলেও বেহিসাবি সহিংসতাকে ধিক্কার দেওয়া ও পূর্ববর্তী ভূরাজনীতির ধাঁচ নিয়ে আক্ষেপ ছাড়া নতুন কিছু বলার তেমন নেই। পর্যটকদের কাছ থেকে ধর্ম জানতে চাওয়ার পর হিন্দু পুরুষদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়—এমন ভয়াবহ দৃশ্যের দায় অবধারিতভাবে পাকিস্তান বা তার ‘সম্পৃক্ত’ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ঘাড়েই চেপেছে। কিন্তু কোনও প্রমাণ মেলেনি, ধরা পড়েনি কোনও অপরাধীও।
তার বদলে শত শত গ্রেপ্তার আর নানা অজুহাতে বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে—ইসরায়েল, ভারত ও পাকিস্তানের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ কৌশলে যা সাধারণ ঘটনা। মজার বিষয়, সরাসরি সংঘাতের কয়েকটি (সুখের বিষয়, সীমিত) দিনে ভারতকে পুরোপুরি সমর্থন করা একমাত্র রাষ্ট্র ছিল ইসরায়েল। ভারত পাকিস্তানে যেসব ড্রোন পাঠিয়েছে, তার বেশির ভাগই ইসরায়েলি; সামান্য ক্ষতি ছাড়া তেমন কিছু বদলাতে পারেনি। একইসঙ্গে পাকিস্তানের বহু ড্রোনও উল্টো পথে গেছে।
কে যে চাপ দিয়েছে তা যতই বিতর্কিত হোক, গত সপ্তাহান্তে সহিংসতা বন্ধ হওয়া স্বাগত জানাতেই হয়। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ডনাল্ড ট্রাম্প কৃতিত্ব দাবি করছেন, তবে পাকিস্তান অনেক দেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, আর ভারত একে দেখাচ্ছে কেবল এক তরফা অস্থায়ী সমঝোতা হিসেবে। শনিবার ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টায় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের খবর মিললেও তা দ্রুত স্তিমিত হয়। এই ক্ষীণ শান্তি কতটা টেকে, তা-ই এখন উপমহাদেশের আশা-ভরসার কেন্দ্র।
চার দিনের এই ‘যুদ্ধ’—১৯৬৫ ও ১৯৭১-এর সংঘর্ষের তুলনায় অনেক ছোট হলেও—সবচেয়ে বিভীষিকাময় ফল ছিল বেসামরিক, বিশেষত শিশুর, প্রাণহানি। পার্থক্য হলো, এবারের সংঘাত মূলত ভারতের ‘ভক্ত’ শাসনের বোকামি থেকেই উৎস। সংঘাতকালে প্রায় অদৃশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী (যার পাকিস্তানি সমকক্ষের ক্ষমতা তুলনামূলক কম) সোমবার শুধু জানালেন, ‘অপারেশন সিন্দুর’ চলছেই।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব আকর্ষণীয় হলেও ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
মার্কিন গণমাধ্যম বলছে, ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ‘হাতে-কলমে না জড়ানোর’ কথা বলার কিছুক্ষণ পরই তিনি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফোন হাতে নেন—গোপন তথ্য ইঙ্গিত দেয়, পরিস্থিতি পারমাণবিক পর্যায়ে গড়াতে পারে।
উস্কানি যেখান থেকেই আসুক, উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া স্বস্তির বিষয়। পাকিস্তানে সাধারণভাবে স্বাগত জানানো হলেও ভারতে প্রায়ই কটাক্ষ করা হচ্ছে—বিশেষত তারা, যারা লাহোর দখল কিংবা করাচি বন্দর ধ্বংসের মতো আজগুবি কল্পকথা বানাচ্ছিল। এর বিপরীতে বলা যায়, ভারতের অকারণ আগ্রাসনই ইসলামাবাদের হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় সামরিক শক্তিকে আরও দৃঢ় করেছে।
এদিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করেছেন, রাষ্ট্র অতীতে লস্কর-ই-তইবা ও জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছিল—এটা নতুন কিছু নয়, আর এর কোনোটি পাহালগামের গণহত্যার জন্য দায়ী, তা-ও প্রমাণ হয় না। কারও জন্যই আশ্রয় প্রাপ্য নয়, তবে মজার বিষয় হলো ভারত যেখানে লস্কর-ই-তইবাকে অভিযুক্ত করেছে, সেখানে জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান দাবি করেছেন, বাহাওয়ালপুরে হামলায় তাঁর কয়েকজন স্বজন নিহত হয়েছেন।
প্রায় ৮০ বছর আগের প্রেক্ষাপটে, তৎকালীন নবগঠিত জাতিসংঘ যেদিন গণভোটের কথা বলেছিল, সেদিন থেকেই ভারতের সরকার এতে অনীহা দেখিয়েছে। জওহরলাল নেহরুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেক কারণে শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও তিনি অন্ধ ছিলেন; উত্তরসূরিরাও সে পথেই থেকেছেন—যতক্ষণ না মোদি সরকার ছয় বছর আগে অঞ্চলটি কার্যত দখল করে নিয়ে অধিকৃত ভূখণ্ডের তকমা পাকাপোক্ত করে। পাকিস্তান শক্তিপ্রয়োগে এ অবিচার পাল্টাতে পারবে না, আবার নয়াদিল্লির জবরদস্তিও চূড়ান্ত সমাধান টানতে পারবে না। ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব মনোহর হলেও, তাঁর বেশির ভাগ প্রচেষ্টার মতোই, ফলহীন হতে পারে।
পাকিস্তান-ভারতের ভৌগোলিক অবিচ্ছেদ্যতা আর অভিন্ন ইতিহাস সব সময়ই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও মুক্ত বাণিজ্যকে সমর্থন করেছে। হিন্দুত্বের প্রবক্তা ও তাদের পাকিস্তানি সমগোত্রীয়দের বোধহয় নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে। আমার জীবদ্দশায় এমন রূপান্তর হবে বলে মনে হয় না, তবু আশা থাকেই।
ডন পত্রিকায় প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২৫