সারাক্ষণ রিপোর্ট
উপহারের পটভূমি
১৩ বছর পুরোনো, প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বোয়িং ৭৪৭-৮ জেট কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে “অস্থায়ী এয়ার ফোর্স ওয়ান” হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিতে রাজি হয়েছেন। বোয়িং-এর দুটি নতুন ভিসি-২৫বি (নতুন এয়ার ফোর্স ওয়ান) নির্ধারিত সময়ের কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়ায় হোয়াইট হাউস এটিকে একটি দ্রুত সমাধান বলে তুলে ধরছে। ট্রাম্প সরাসরি বলেছেন, “ফ্রি প্লেন ফিরিয়ে দেওয়া বোকামি হবে।”
কেন জরুরি সাময়িক সমাধান
বোয়িং-এর ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প এখন ২০২৭ সালের আগে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে, কাতারি বিমানের মাধ্যমে অন্তত দুই-তিন বছর রাষ্ট্রপতির যাতায়াত নির্বিঘ্ন রাখা যাবে। তবে বিমানটি ইতিমধ্যেই টেক্সাসের স্যান অ্যান্টোনিও বিমানঘাঁটিতে গোপনে সংস্কারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে অনুসন্ধানী সূত্রের খবর।

বিলাসিতার পুরো ছবি
দুই ডেকের এ “উড়ন্ত প্রাসাদে” রয়েছে প্রধান বেডরুম, অতিথি কক্ষ, একাধিক লাউঞ্জ, কনফারেন্স স্যুট, ফুল-সাইজের চিকিৎসাকক্ষ ও নয়টি টয়লেট; অভ্যন্তরটিতে স্বর্ণখচিত অলংকরণ আর চামড়ার আসন। কাতারি রাজপরিবারের ভিভিআইপি বিন্যাসটি এতটাই প্রদর্শনমুখী যে, বহু বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা—সামরিক যন্ত্রপাতি বসালে এর শৌখিন কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবু ত্যাগ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
সংবিধান ও এমোলুমেন্টস ক্লজের মারপ্যাঁচ
মার্কিন সংবিধানের এমোলুমেন্টস ক্লজ অনুযায়ী কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশি উপহার গ্রহণ বেআইনি। হোয়াইট হাউস দাবি করছে, বিমানটি “বাহনের জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের জমা-সম্পদ” হিসেবে গ্রহণ করা হবে, তাই এটি উপহার নয়। ডেমোক্র্যাটদের মতে, এটিই এক কৌশলী ব্যাখ্যা; কংগ্রেসম্যান রিচি টোরেস ইতিমধ্যেই তদন্তের দাবি তুলেছেন।
নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত পুনর্গঠন
আধা-সামরিক বিমান থেকে পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক-দুর্যোগ-সহন কমান্ড পোস্টে রূপ দিতে হলে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী ব্যবস্থা, সাইবার-নিরাপদ যোগাযোগ, ইএমপি সুরক্ষা, গোপন কেবলিং—সব কিছুই প্রায় কঙ্কাল পর্যন্ত খুলে নতুন করে বসাতে হবে। রায়টার্সকে সাবেক এয়ার ফোর্স কর্মকর্তারা বলেছেন, এমন সংস্কারে কয়েক শ কোটি ডলার ব্যয় এবং অন্তত দুই-তিন বছর সময় লাগবে; তবু আন্তর্জাতিক আকাশপথে উড়তে হলে ফাইটার জেট এস্কর্ট দিতে হতে পারে।

কূটনৈতিক যোগফল
উপহার-ঘোষণার পাশাপাশি ট্রাম্প কাতারে প্রায় ৯৬ বিলিয়ন ডলারের বোয়িং বিক্রয় ও প্রতিরক্ষা-অফসেট চুক্তি প্রকাশ করেছেন। তাই সমালোচকরা বলছেন, “উড়ন্ত প্রাসাদ” আসলে কাতার-যুক্তরাষ্ট্র রণকৌশলের এক অংশ, যেখানে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত মোহ ও দুই দেশের অস্ত্রবাণিজ্য এক সুতোয় বাঁধা।
রাজনৈতিক বিতর্ক
জনমত-পরীক্ষায় দেখা গেছে, রিপাবলিকান শিবিরের একটি অংশও নিরাপত্তা-ঝুঁকি ও সাংবিধানিক প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। ওয়াশিংটনে বিরলভাবে দুই দলীয় কণ্ঠ মিলেছে—“বিমানের দাম শূন্য ডলার হলেও করদাতার খরচ দাঁড়াতে পারে এক বিলিয়ন!” ট্রাম্প অবশ্য এটিকে “স্বচ্ছ, লাভজনক লেনদেন” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “আমেরিকা সব সময়ই অন্যদের দেয়, কেউ দিলে ফিরিয়ে দেবো কেন?”

সামনের চ্যালেঞ্জ
১) কংগ্রেসের শুনানি ও সম্ভাব্য তদন্ত।
২) প্রতিরক্ষা দপ্তরের পূর্ণাঙ্গ ব্যয়-সমীক্ষা; এল-থ্রি-হ্যারিস ইতিমধ্যেই প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে।
৩) সাংবিধানিক অভিযোগ আদালতে গড়াতে পারে—এমোলুমেন্টস ক্লজ ও ক্ষমতার সীমা প্রশ্নে।
৪) আন্তর্জাতিক সফরে বিমানটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়া নিরাপত্তা প্রোটোকল ঠিক করতে হবে।
কাতারের ‘উড়ন্ত প্রাসাদ’ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আভিজাত্য-বাসনা, সাময়িক রাষ্ট্রপতির চাহিদা এবং জটিল কূটনৈতিক সমীকরণের এক বিস্ময়কর প্রদর্শনী। কিন্তু এতে যে-সব আইনগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা-ঝুঁকি জড়িয়ে আছে, তা বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই আকাশপ্রাসাদ শেষ পর্যন্ত কার স্বার্থ রক্ষা করবে: ট্রাম্পের, কাতারের না কি মার্কিন জনগণের?