সারাক্ষণ রিপোর্ট
নাইজেরিয়ার বাণিজ্যিক নগরী লাগোসের যে বাসায় ১৯৭২ সালে টানা বিদ্যুৎ থাকত, কয়েক বছরের ব্যবধানে সেখানে নিয়মিত লোডশেডিং শুরু হয়। ১৯৮৪-তে একজন আইনজীবীকে তাঁর চেম্বার চালু রাখতে জেনারেটর কিনতে বাধ্য হতে হয়েছে। আজ শহুরে নাইজেরিয়ার বাঁধাধরা শব্দই জেনারেটরের গর্জন—গ্রিড থেকে যে পরিমাণ জ্বলানি আসে, তার দ্বিগুণেরও বেশি বিদ্যুৎ এসব যন্ত্র থেকেই তৈরি হয়।
গ্রিডের সীমাবদ্ধতা
দীর্ঘকাল বিনিয়োগের অভাবে নাইজেরিয়ার জাতীয় গ্রিড কখনও ছয় গিগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ টানতে পারেনি; দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কখনও গ্রিড-সংযোগই পায়নি। তুলনায় ৬৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দক্ষিণ আফ্রিকায় গ্রিড সামলায় ৪৮ গিগাওয়াট, আর আয়তনে নাইজেরিয়ার ছয় ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশের উৎপাদনও ১৬ গিগাওয়াটের কাছাকাছি। মার্চে একদিন ৫ গিগাওয়াট ছুঁতেই নাইজেরিয়ার গ্রিড ভেঙে পড়ে।
অর্থনীতির ওপর চাপ
প্রায় ২৩ কোটি মানুষের দেশে ৯ কোটি মানুষ বিদ্যুৎহীন। হাসপাতালের অপারেশন থেমে যায়, এসি বিলাসিতা মাত্র, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তারা নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়েন। ২০২৩-এ নাইজেরীয়রা গ্রিডের বাইরে বিদ্যুৎ তুলতে ১৬.৫ ট্রিলিয়ন নাইরা (১০.৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার) খরচ করেছে—পরের বছরের জাতীয় বাজেটের ৬০ শতাংশের সমান। সব মিলিয়ে দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ জোগান প্রয়োজনের মাত্র এক-চতুর্থাংশ, প্রায় ২০ গিগাওয়াট।
গ্যাস ও জেনারেশন সংকট
জাতীয় গ্রিডের বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে গ্যাসচালিত কেন্দ্র থেকে, যেগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বল, আবার গ্যাসের দাম বেঁধে রাখায় সরবরাহকারীদের পাওনা মেটানো হয়না। ফলে গ্যাসপ্ল্যান্টগুলো গড়ে তাদের সক্ষমতার অর্ধেকও চালু রাখতে পারে না।
বিল সংগ্রহের জট
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির ৬০ শতাংশ বেসরকারি হলেও তারা ক্রমাগত লোকসানে; সরকারই সবচেয়ে বড় বকেয়াদার। আবুজা বিতরণ কোম্পানি প্রেসিডেন্টের বাসভবনসহ ৮৬টি সরকারি দপ্তরের ৪৭.২ বিলিয়ন নাইরা পাওনা আদায়ে সংযোগ বিচ্ছেদের হুমকি দেয়। লাগোসে নয় বছরের বকেয়া চাইতেই বিমানবাহিনীর সদস্যরা কোম্পানির দফতরে হামলা চালায়।
সরকারি উদ্যোগের অগ্রগতি
নাইজেরিয়া-জার্মানি-সিমেন্স অংশীদারিত্বে গ্রিডের সক্ষমতা ১২ গিগাওয়াট বাড়ানোর চুক্তি ২০১৯-এ হলেও এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়েই আছে। ২০১১-র বেসরকারিকরণে অর্ধেকের বেশি বিতরণ কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ায় নতুন বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী নন। বিদ্যুৎভোক্তাকে বেশি বিল দিতে রাজি করানোও কঠিন; দাম চার গুণ বাড়িয়েও এখনো বিল আদায়ের হার ৬৫ শতাংশ।
অফ-গ্রিড বিকল্প
বিশ্বব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কনসোর্টিয়াম দশকের শেষ নাগাদ ৩০ কোটি আফ্রিকানকে বিদ্যুৎ দিতে ৫৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়, যার বড় অংশ নাইজেরিয়ায়। মাইদুগুরিতে ১২ মেগাওয়াটের সৌর-হাইব্রিড প্রকল্প চালু হয়েছে; রাষ্ট্রের সম্পদ তহবিলসহ কয়েকটি সংস্থা ৫০০ মিলিয়ন ডলারের নবায়নযোগ্য শক্তি তহবিল ঘোষণা করেছে।
দ্বিধায় সরকার
অফ-গ্রিড সফল হলে জাতীয় গ্রিড রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম মানুষের ঘাড়ে পড়বে; খরচ বাড়লে কেউই গ্রিডে থাকতে চাইবে না। সরকার একদিকে গ্রিডে সৌরশক্তি যুক্ত করতে চায়, অন্যদিকে সৌরপ্যানেল আমদানি নিষেধাজ্ঞাও ভাবছে—পথনির্দেশ স্পষ্ট নয়।
বিদ্যুৎ সমস্যার সুরাহা না হলে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাবে না। আফ্রিকার ‘শক্তিধর’ হওয়ার আগে দেশটিকে আগে নিজের ঘর আলোকিত করতে হবে।