০৬:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনে কিছু এলাকার কারখানা বন্ধ রাখার পরামর্শ বিজিএমইএর সাধারণ মানুষের সচেতনতাই ডিজিটাল ভূমিসেবার সাফল্য: সিনিয়র সচিব মানবাধিকার সংগঠনের সতর্কবার্তা: বাংলাদেশে সংকুচিত হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিসর শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি, দাবি না মানলে লং মার্চের ঘোষণা গাজীপুরে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই অন্তত ১০টি বসতঘর দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে উত্তপ্ত বিক্ষোভ, ব্যারিকেড ভেঙে ঢোকার চেষ্টা আইসিসিআরের দিগন্ত সিরিজে সংগীতের সন্ধ্যা কলকাতায় বাংলাদেশের সঙ্গে শুল্ক কমাতে বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করল জাপান চব্বিশ সেকেন্ডে উনত্রিশ গুলি, আত্মরক্ষার দাবি ঘিরে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে মার্কোস জুনিয়র ২০২৫ সালে কোনোমতে টিকে ছিলেন। ২০২৬ সালে কি তিনি পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে পাবেন?

সেই বন, যেখানে একদিন বাঘ থাকত

  • Sarakhon Report
  • ০৪:০০:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
  • 255

সারাক্ষণ রিপোর্ট

বৃদ্ধ লোকটির নাম মজিবর হোসেন। বয়স এখন আশি ছুঁইছুঁই। গাজীপুরের একটি ছোট গ্রামে তার বসবাস। সকালে উঠেই পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসে তিনি দূরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সবুজ ছায়ার দিকে চেয়ে থাকেন। আর মাঝে মাঝে ফিসফিসিয়ে বলেন, “এই বনটা আগে এমন ছিল না… এখানে বাঘ থাকত।”

শুরুটা ছিল ভয় আর বিস্ময়ের এক বনজীবন

মজিবর যখন কিশোর, তখনকার ভাওয়াল ছিল এক রোমাঞ্চকর জায়গা। গভীর বন,উঁচু সালগাছ,পাখির ডাক, হরিণের ছুট, আর রাত গভীর হলে দূর থেকে শোনা যেত বাঘের গর্জন।

“আমরা ছোটবেলায় সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরতাম,” মজিবর বলেন।“মা বলতো, আজ রাতে বাঘ নাকি বনপথে বেরিয়েছে।”

বনের প্রান্তে বসবাসকারী মানুষদের জীবন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে। দিনের আলো ফুরানোর আগেই সবাই গৃহে ফিরত, আর রাতের বুকে চলত বনজ প্রাণীদের অবাধ বিচরণ।

ভাওয়ালে তখন ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার—বনের একচ্ছত্র রাজা। তার চলাচলে ছায়া ঘন হতো। গোপনে ঘুরে বেড়াত চিতাবাঘ, মাঝে মাঝে চোখ জ্বলজ্বল করত গাছের ফাঁকে। চিত্রল হরিণ পাল ধরে দৌড়াত জলাশয়ের ধারে, আর গাছের উপর থেকে চিৎকার করত বানর আর হনুমান। কোথাও দেখা মিলত বুনো শূকর, কেউ কেউ বলত, “এই শূকররা রাগ করলে মানুষকেও আক্রমণ করে।”

ধীরে ধীরে সব হারিয়ে যেতে লাগল

সময়ের সঙ্গে বন বদলাতে শুরু করল। এক সময় যেখান দিয়ে বাঘ হেঁটে যেত, সেখানেই রাস্তা হলো। বনের ভেতর ট্রাক ঢুকতে শুরু করল—কাঠের জন্য। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু হয় নির্বিচার বন উজাড়। গাছ কাটা, জমি দখল, কৃষিজমি বানানোর লোভে হাজার হাজার গাছ হারিয়ে গেল।

“একদিন একদল লোক এসে আমাদের পাশের বন থেকে একটা চিত্রল হরিণ ধরে নিয়ে গেল,” স্মৃতি হাতড়ে বলেন মজিবর। “আমরা কিছু বলতে পারিনি, কারণ ওরা বন্দুক নিয়ে এসেছিল।”

তখনই শুরু হয় প্রাণী পাচার আর শিকার। বাঘের চামড়া বিদেশে বিক্রি হতো, হরিণের মাংস চলে যেত শহরের হোটেলে। বনভূমির পাশে মানুষ গড়ে তোলে ঘর, দোকান, বাজার। প্রাণীরা পেছনে ঠেলতে ঠেলতে একসময় উধাও হয়ে যায়।

আজকের ভাওয়ালশুধু গাছপ্রাণ নেই

আজ যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটিকে আমরা দেখি, তা যেন এক নিঃশব্দ স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে এখনো কিছু বানরবুনো শূকর ও পাখি টিকে আছে, কিন্তু সেই রাজসিক বাঘ, লাজুক চিতাবাঘ বা দলবদ্ধ হরিণের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিছু অতীতের গল্প—মজিবরের মতো বয়স্কদের স্মৃতিতে বন্দি।

বনের ভবিষ্যৎআছে কি কোন আশার আলো?

এখন প্রশ্ন হলো, এই বন কি আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে?

পরিবেশবিদদের মতে, যদি এখনই উদ্যোগ নেওয়া হয়—পুনরায় দেশীয় গাছ লাগানো, বনের ভেতর পর্যটনের চাপে নিয়ন্ত্রণ আনা, এবং স্থানীয় মানুষকে বন রক্ষায় অংশীদার করা—তবে হয়তো বনের কিছু প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

মজিবর আজও আশায় থাকেন। “আমি জানি, বাঘ হয়তো আর ফিরবে না,” তিনি বলেন। “কিন্তু যদি হরিণের দল আবার দৌড়ায়, আর পাখিরা সকালবেলা গান গায়, তাহলেই বোধহয় এই বন আবার বাঁচবে।”

জনপ্রিয় সংবাদ

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনে কিছু এলাকার কারখানা বন্ধ রাখার পরামর্শ বিজিএমইএর

সেই বন, যেখানে একদিন বাঘ থাকত

০৪:০০:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

বৃদ্ধ লোকটির নাম মজিবর হোসেন। বয়স এখন আশি ছুঁইছুঁই। গাজীপুরের একটি ছোট গ্রামে তার বসবাস। সকালে উঠেই পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসে তিনি দূরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সবুজ ছায়ার দিকে চেয়ে থাকেন। আর মাঝে মাঝে ফিসফিসিয়ে বলেন, “এই বনটা আগে এমন ছিল না… এখানে বাঘ থাকত।”

শুরুটা ছিল ভয় আর বিস্ময়ের এক বনজীবন

মজিবর যখন কিশোর, তখনকার ভাওয়াল ছিল এক রোমাঞ্চকর জায়গা। গভীর বন,উঁচু সালগাছ,পাখির ডাক, হরিণের ছুট, আর রাত গভীর হলে দূর থেকে শোনা যেত বাঘের গর্জন।

“আমরা ছোটবেলায় সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরতাম,” মজিবর বলেন।“মা বলতো, আজ রাতে বাঘ নাকি বনপথে বেরিয়েছে।”

বনের প্রান্তে বসবাসকারী মানুষদের জীবন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে। দিনের আলো ফুরানোর আগেই সবাই গৃহে ফিরত, আর রাতের বুকে চলত বনজ প্রাণীদের অবাধ বিচরণ।

ভাওয়ালে তখন ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার—বনের একচ্ছত্র রাজা। তার চলাচলে ছায়া ঘন হতো। গোপনে ঘুরে বেড়াত চিতাবাঘ, মাঝে মাঝে চোখ জ্বলজ্বল করত গাছের ফাঁকে। চিত্রল হরিণ পাল ধরে দৌড়াত জলাশয়ের ধারে, আর গাছের উপর থেকে চিৎকার করত বানর আর হনুমান। কোথাও দেখা মিলত বুনো শূকর, কেউ কেউ বলত, “এই শূকররা রাগ করলে মানুষকেও আক্রমণ করে।”

ধীরে ধীরে সব হারিয়ে যেতে লাগল

সময়ের সঙ্গে বন বদলাতে শুরু করল। এক সময় যেখান দিয়ে বাঘ হেঁটে যেত, সেখানেই রাস্তা হলো। বনের ভেতর ট্রাক ঢুকতে শুরু করল—কাঠের জন্য। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু হয় নির্বিচার বন উজাড়। গাছ কাটা, জমি দখল, কৃষিজমি বানানোর লোভে হাজার হাজার গাছ হারিয়ে গেল।

“একদিন একদল লোক এসে আমাদের পাশের বন থেকে একটা চিত্রল হরিণ ধরে নিয়ে গেল,” স্মৃতি হাতড়ে বলেন মজিবর। “আমরা কিছু বলতে পারিনি, কারণ ওরা বন্দুক নিয়ে এসেছিল।”

তখনই শুরু হয় প্রাণী পাচার আর শিকার। বাঘের চামড়া বিদেশে বিক্রি হতো, হরিণের মাংস চলে যেত শহরের হোটেলে। বনভূমির পাশে মানুষ গড়ে তোলে ঘর, দোকান, বাজার। প্রাণীরা পেছনে ঠেলতে ঠেলতে একসময় উধাও হয়ে যায়।

আজকের ভাওয়ালশুধু গাছপ্রাণ নেই

আজ যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটিকে আমরা দেখি, তা যেন এক নিঃশব্দ স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে এখনো কিছু বানরবুনো শূকর ও পাখি টিকে আছে, কিন্তু সেই রাজসিক বাঘ, লাজুক চিতাবাঘ বা দলবদ্ধ হরিণের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিছু অতীতের গল্প—মজিবরের মতো বয়স্কদের স্মৃতিতে বন্দি।

বনের ভবিষ্যৎআছে কি কোন আশার আলো?

এখন প্রশ্ন হলো, এই বন কি আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে?

পরিবেশবিদদের মতে, যদি এখনই উদ্যোগ নেওয়া হয়—পুনরায় দেশীয় গাছ লাগানো, বনের ভেতর পর্যটনের চাপে নিয়ন্ত্রণ আনা, এবং স্থানীয় মানুষকে বন রক্ষায় অংশীদার করা—তবে হয়তো বনের কিছু প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

মজিবর আজও আশায় থাকেন। “আমি জানি, বাঘ হয়তো আর ফিরবে না,” তিনি বলেন। “কিন্তু যদি হরিণের দল আবার দৌড়ায়, আর পাখিরা সকালবেলা গান গায়, তাহলেই বোধহয় এই বন আবার বাঁচবে।”