আজ ২৫ মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। দেশজুড়ে গভীর শ্রদ্ধা ও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হচ্ছে এই বাঙালির গর্বের কবির জন্মদিন। বিদ্রোহ, সাম্য, মানবতা, নারীর অধিকার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান—সব মিলিয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতীক। শুধু কবি নয়, তিনি ছিলেন সৈনিক, সাংবাদিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সমাজ-সচেতন বিপ্লবী কণ্ঠস্বর।
বিদ্রোহী কবির যাত্রা
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই তাঁর বেড়ে ওঠা। জীবনের প্রথম দিকে মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ, পরে লেটো গানের দলে যোগ, এরপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে চাকরি—এইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে গড়ে তোলে বাস্তবের কবি হিসেবে। সেনাবাহিনী থেকে ফিরে তিনি লিখতে শুরু করেন, সম্পাদনা করেন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা, যার কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
নজরুলের গান ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা
কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্ট বিদ্রোহী কবিতা ও গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর গানের ভাষা ছিল প্রতিবাদের, সংগ্রামের, মুক্তির।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এ নজরুলের অনেক গান ছিল অনুপ্রেরণার উৎস।
বিশেষ করে যেসব গান যুদ্ধকালীন সময়ে বেতারে বারবার বাজানো হতো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- কারার ঐ লৌহকপাট
- চল চল চল
- জয়বাংলা বাংলার জয়
- বিদ্রোহীর গান
এই গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় করত, আর জনসাধারণের মধ্যে জাগিয়ে তুলত সাহস ও প্রতিরোধের স্পৃহা।
বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলাদেশে আগমন
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগত উদ্যোগে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তখন কবি ছিলেন অসুস্থ ও বাকরুদ্ধ। ভারত সরকারের অনুমতি ও সহযোগিতায় তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে ঢাকায় আনা হয়। নজরুল ও তাঁর পরিবারের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয় এবং তাঁকে জাতীয় মর্যাদায় সম্মানিত করা হয়।
এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে নজরুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি নির্মাণের অংশ।
সাম্য ও নারীমুক্তির কণ্ঠস্বর
নজরুল এমন এক সময়ে লিখছিলেন, যখন নারী ছিল সমাজের নিপীড়িত অংশ। অথচ তাঁর লেখনীতে নারী উঠে এসেছে আত্মবিশ্বাসী, সংগ্রামী ও সৃষ্টিশীল রূপে।
তিনি লিখেছিলেন—
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
এই পংক্তি শুধু কবিতা নয়, এক সামাজিক দর্শন। নজরুল ছিলেন প্রথম কবিদের একজন, যিনি নারীমুক্তিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার অংশ হিসেবে দেখেছেন।
ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অবস্থান
নজরুল ইসলামের লেখায় ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ছিল স্পষ্ট। তিনি ধর্মকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের পক্ষে, কিন্তু ধর্মের নামে বিভাজন, ব্যবসা ও সহিংসতা দেখলে গর্জে উঠতেন।
তিনি বলেছিলেন—
“আমি কা‘বার ঐ খোল দরজা, আমি গীর্জার খ্রিস্ট!
আমি মন্দিরে পূজার আগুন, আমি বেদ বাইবেল কোরান।”
এই পংক্তির মাধ্যমে নজরুল শুধু ধর্মীয় সহাবস্থানের বার্তা দেননি, বরং ধর্মীয় মৌলবাদ ও ব্যবসায়ীক ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁর কলম শাণিত রেখেছেন।
সংগীতে নজরুল: বাংলা গানের নবযুগ
কাজী নজরুল প্রায় চার হাজার গান রচনা ও সুরারোপ করেন, যা বাংলা সংগীতে নজরুল সংগীত নামে পরিচিত। তাঁর গানে উঠে এসেছে প্রেম, প্রকৃতি, বিপ্লব, দুঃখ-বেদনা, এমনকি ইসলামি ও হিন্দু ধর্মের গান—সব মিলিয়ে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগীত জগৎ।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও আজকের আয়োজন
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরকারের এক গেজেটের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কুমিল্লা, ঢাকা, ও পশ্চিমবঙ্গসহ নানা জায়গায় তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও নজরুল পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে।
মৃত্যুর পরেও প্রাসঙ্গিক
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট নজরুল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে। কিন্তু আজও তিনি জীবন্ত, তাঁর কবিতা, গান, এবং আদর্শের মধ্যে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক কবি, যিনি শুধু সাহিত্য নয়, বাংলা জাতিসত্তার মুক্ত চেতনার পুরোধা। বিদ্রোহ, সাম্য, নারীর অধিকার, ধর্মীয় সহনশীলতা—সব কিছুর এক ঐক্যবদ্ধ রূপ নজরুল। তাঁর জন্মদিনে তাই শুধু শ্রদ্ধা নয়, দরকার তাঁর আদর্শকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।
তিনি লিখেছিলেন—
“আমি চিরবিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা রক্তমাখা কালো পতাকা!”
আজ তাঁর সেই বিদ্রোহ, সেই সাম্যের বার্তা নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক, নতুন লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।