ইতিহাসের বিপর্যয় থেকে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত
দু’বার মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া দেশ পোল্যান্ড, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সময় সোভিয়েত স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ দমন-পীড়নের পর আজকের পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যতম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটি এখন ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির চেয়েও বড় সেনাবাহিনী গঠন করেছে এবং জীবনমানের দিক দিয়ে জাপানকেও অতিক্রম করতে চলেছে।
এক মোড়ল নির্বাচন এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক বাঁক
এই উত্তরণের মাঝেই পোল্যান্ডের জনগণ ১ জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে পাচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একদিকে রয়েছে আইন ও ন্যায়বিচার (PiS) পার্টির প্রার্থী, যার ডানপন্থী জাতীয়তাবাদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংঘর্ষে বিশ্বাস করে। অপরদিকে, কেন্দ্রীয় রাজনীতির পক্ষের প্রার্থী মনে করেন, এই অনিশ্চিত বিশ্বে পোল্যান্ডকে ইউরোপের সঙ্গে একযোগে থাকতে হবে।
ইইউ-তে অন্তর্ভুক্তির সুফল
১৯৯৫ সালের পর থেকে পোল্যান্ডে মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়েছে। ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির পর কোভিড-১৯ এর অল্প সময় বাদে আর কখনো দেশটি মন্দায় পড়েনি। গত দুই দশকে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪ শতাংশ।
রাজধানী ও গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের ছাপ
ওয়ারশর ভারসো টাওয়ার এখন ইউরোপের (রাশিয়া বাদে) সবচেয়ে উঁচু ভবন। শহরে তথ্যপ্রযুক্তি স্টার্টআপ, ডিজাইনার দোকান এবং ক্যাফের ভিড়। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলেও ইউরোপীয় তহবিলের সহায়তায় নতুন রাস্তা, চাষাবাদ ও গৃহ নির্মাণ হচ্ছে।
অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় আত্মনির্ভরতা
জার্মানির কাছাকাছি হওয়ায় উৎপাদন শিল্পে সাফল্য পেয়েছে পোল্যান্ড। জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জের নেতৃত্বে সম্ভাব্য অবকাঠামো ও প্রতিরক্ষা খরচ বৃদ্ধি পোল্যান্ডকেও উপকৃত করবে। রাশিয়ার হুমকি মাথায় রেখে পোল্যান্ড তার প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ৪ শতাংশের বেশি ব্যয় করে, যা ২০২৬ সালে ৫ শতাংশ ছাড়াবে।
ইউরোপীয় নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং তুরস্কের পর পোল্যান্ডই ইউরোপের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী গড়েছে। এখন ইউরোপীয় নিরাপত্তা আলোচনায় ‘চার মাসকেটিয়ার’-এর এক সদস্য হিসেবে পোল্যান্ডকেও ধরা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক সম্প্রতি ইউক্রেনে গিয়ে বার্তা দিয়েছেন, ইউরোপ ইউক্রেনের পাশে আছে।
PiS-শাসনের পরিণতি ও প্রেসিডেন্টের ভূমিকা
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা PiS দল আদালত, মিডিয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বেসরকারি খাতসহ বহু প্রতিষ্ঠান নিজের দখলে নেয়। এর ফলে ইইউ পোল্যান্ডের কিছু তহবিল সাময়িকভাবে স্থগিত করে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা অনেক সংস্কার বাধাগ্রস্ত করেন, এবার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন PiS-এর কঠোর মতাদর্শী কারোল নাভরককি। নির্বাচিত হলে তিনি ডোনাল্ড টাস্কের সংস্কার পরিকল্পনা ব্যাহত করতে পারেন।
ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে টাস্কের ভূমিকা
ডোনাল্ড টাস্ক এক সময় ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর মিত্র ও ওয়ারশর মেয়র রাফাল ত্রজাস্কভস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে।
একটি ভুল পদক্ষেপ কি সব অর্জন নষ্ট করবে?
যদি PiS সমর্থিত প্রার্থী নাভরককি বিজয়ী হন, তবে শুধু পোল্যান্ড নয়, ইউরোপও এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারাবে। পোল্যান্ড হারাবে তার কঠিন পরিশ্রমে অর্জিত কেন্দ্রীয় ভূমিকাটি।
সামনে কী?
প্রথম রাউন্ডে কঠোর ডানপন্থী প্রার্থীরা প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাই দ্বিতীয় রাউন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোল্যান্ড যদি ভুল পথে হাঁটে, তবে তা কেবল দেশের নয়, ইউরোপীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ হবে।