০১:০৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

এ মুহূর্তে সেনাবাহিনী ও বিএনপির দায়ভার

যদিও বিষয়টি বেশ আগের থেকেই স্পষ্ট ছিলো, তারপরেও গত কয়েকদিনের ঘটনা আরও স্পষ্ট করেছে—বাংলাদেশকে মব-ভায়োলেন্সমুক্ত করা, বিভিন্ন এলাকা- ভিত্তিক বিশেষ মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের রাজত্ব থেকে বের করে আনা, ঢালাও চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘুদের ওপর সরব ও নীরব চলমান নির্যাতন বন্ধ করা, সর্বোপরি রাষ্ট্রের বেশিক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দূর করা, রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ পুলিশকে কার্যকর করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সময়মতো দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা—এখন একমাত্র সেনাপ্রধানের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

সেনাপ্রধান ও তাঁর ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর সর্বশেষ যে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরপরই দেশে একটি অতি নিম্নমানের (যাকে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ মানের বলা যায়) নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দেশের সচেতন জনগণ সবাই সেই নাটকের মূল কারণ বুঝে ফেলেছে।

এই নাটক কেন হলো এবং উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি—তাও এখন সবার কাছে পরিস্কার। কারণ, একটি শ্রেণীর কাছে ক্ষমতা ভোগের যে  সুখের অনুভূতি প্রবলভাবে কাজ করছে। তারা জানে যে কোনোভাবে ক্ষমতা ও ক্ষমতার চারপাশে না থাকলে এই সুখ তারা ভোগ করতে পারবে না।

আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে যারা সক্রিয়, তাদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি ছাড়া আর কারও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার কোনো শক্তি নেই। যেহেতু এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, তাই বিএনপির পরে বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। ক্যাডারভিত্তিক এই দলটি বিএনপির সমর্থন ছাড়া সর্বোচ্চ তিন থেকে পাঁচটি আসনে এখনও এদেশে নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেনি। অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কিছু ভোট আছে, তবে বিএনপির মতো দলের বিপরীতে তাদের কোনো আসনে জয়লাভ করার কোনো ক্ষমতা নেই। বরং যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং টাকার ছড়াছড়ি না থাকে, তাহলে অনেক স্বতন্ত্র ও  ভদ্র প্রার্থীর এলাকা- ভিত্তিক সুনামের কারণে জয়লাভ করার সম্ভাবনা আছে।

একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কখনো অনেকটা সহিংস, কখনো অহিংস আন্দোলন গত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি করেছে। আওয়ামী লীগও তাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন করেছে। বিএনপির নেতারা রাজবন্দির মতো বারবার জেলে গেছেন, আবার ফুলের মালা গলায় দিয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নিজেদের সংগঠন না গড়ে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন করে, মামলা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে বেশিক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতা স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের কালচার নষ্ট করে সমাজটাকে দুর্বৃত্তায়নের দিকে আরও ঠেলে দেয়। যে দুর্বৃত্তায়নের চরম প্রকাশ এখন বর্তমান ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটছে। যার ফলে দেশ আজ শুধু চরম নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে নয়, সেনাবাহিনী যদি এমন আন্তরিকভাবে এবং সমস্ত মান-অপমান সহ্য করে দায়িত্ব পালন না করতো—তাহলে দেশ এতদিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা শুধু স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কারণ, শুধুমাত্র দুর্বৃত্ত নয়, আমাদের সমাজের অনেকেই সচেতন বা অবচেতনভাবে কেন এই প্রাইভেট বাহিনীর মব ভায়োলেন্সকে সমর্থন করছে, তা সত্যিই ভবিষ্যতের বড় গবেষণার বিষয়।

৫ ফেব্রুয়ারি এই সরকারের সমর্থক, আমারও অতি আপনজন- একজনকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, “ভাই, দেশ কি এভাবে প্রাইভেট বাহিনী দিয়ে চলবে?” তিনি বলছিলেন, “দেশটি সৃষ্টির পর থেকে তো প্রাইভেট বাহিনী দিয়েই চলছে”। তার সে উত্তর শুনে আর কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। তাঁর মতো আমিও ’৬৯ এর গণঅভূত্থ্যান দেখেছি, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন দেখেছি। সব ক্ষেত্রেই ছাত্ররা অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন শেষে পড়াশোনায় বা নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে। কেউ কোনো প্রাইভেট বাহিনী তৈরি করেনি। আর এ দেশে মব ভায়োলেন্স তো একেবারেই নতুন।

যাহোক, দেশের যা পরিস্থিতি তা আমার থেকে দেশের প্রতিটি মানুষ আরও বেশি জানেন। তাই এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে দেশ যেদিকে এগুচ্ছে তা যে একটি ভয়াবহ দিক- সেটা সেনাপ্রধানের বক্তব্য ও সেনাবাহিনীর মুখপত্রের প্রেস ব্রিফিং থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেনাপ্রধান সেখান থেকে দেশকে ও দেশের শেষ সুসংগঠিত আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্যে অতি দ্রুত নির্বাচনের কথা বলেছেন।

সেনাপ্রধান বক্তব্যের পরে দেশে একটি নাটকও অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কেউ কেউ ওই নাটককে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার জন্যে বলছেন, বল এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের কোর্টে। আমি তা মনে করি না। কারণ ভোটে দাঁড়ালে তারা সবাই সর্বোচ্চ আড়াইশ থেকে তিনশ ভোটের মালিক। তাদের কট্টর সমর্থক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র একটি দল তিন-চারটে আসনে হয়তো জিততে পারে। তাও আওয়ামী লীগ না থাকলে, ত্রিমুখী ভোট না হলে—সেটাও ঘটবে না। এমত অবস্থায় বল এখন বিএনপির কোর্টে। আর মূল কাজটি এখন একমাত্র সম্পন্ন করতে পারেন সেনাপ্রধান ও তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেন যেন বিএনপি সেই বল সুন্দরভাবে খেলতে বা পাস দিতে পারছে না। এখান থেকে বেশ কয়েকমাস আগে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হলে তাঁকে ছোট একটা প্রশ্ন করেছিলাম, ৫ তারিখ সরকার পতনের পরে বড় দল ও ১৬ বছর ধরে আন্দোলন করা দল বিএনপি কেন ড্রাইভিং সিটে বসতে পারলো না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা বিশ্বাস করেছিলাম।” অনুষ্ঠান, তাই কথা বাড়াইনি। তবে রাজনীতিতে বিশ্বাস করা এক বিষয়, আর ড্রাইভিং সিটে বসা ভিন্ন বিষয়।

যাহোক, ৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক রাজনীতি যেখানে ছিলো বর্তমানে সেখানে নেই। তাছাড়া নয় মাসে পদ্মা-মেঘনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। যেহেতু আমার জন্ম হিন্দু ঘরে, তাই একটি বিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত, দেবতা বিসর্জন হয়ে গেলে তার মূর্তির শরীরের সমস্ত রঙ ও কাঁচা মাটি উঠে গেলে—নদী বা দীঘির জলে শুধুই বাঁশের গায়ে লাগানো খড়কুটোই ভাসতে থাকে। ওই বাঁশের গায়ে লাগানো খড়কুটো আর যাই হোক, দেবতা নন। বাংলাদেশের মানুষও নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে দেবতার শরীরের প্রকৃত খড়কুটোর রূপটি দেখে ফেলেছেন। বিএনপিও যে সেটা দেখে ফেলেছে, তার প্রমাণ তাদের নেতা আমীর খসরু মাহমুদ ও সালাউদ্দিন আহমদের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। তবে তার পরেও যেন বিএনপির ভেতর কোথায় একটা দ্বিধা কাজ করছে বলে দেশের সচেতন মানুষ মনে করছে।

তবে দেশের সামনে এখন এ সত্য এসে দাঁড়িয়েছে—দেশে যাতে নির্বাচন হয়, দেশ একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ঢুকে একটা নির্বাচন করতে পারে—সে কাজের একটি বড় দায়ভার জাতীয়ভাবে বিএনপির ওপর পড়েছে। এবং বিএনপি নেতারা রাজনীতিতে নিশ্চয়ই আমার মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তবে তারপরেও দেশের সামনে এখন এ বিষয়টি স্পষ্ট, একমাত্র সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী ছাড়া দেশের শক্তিশালী কোনো অংশ নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে নয়।

তাই বিএনপি সহ অন্যান্য যে রাজনৈতিক দল ও শক্তি এবং দেশের সাধারণ মানুষ যারা একটি সুন্দর নির্বাচন চান—তাদের সামনে এখন একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আর সে সিদ্ধান্তটিও স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেনাপ্রধান ও তাঁর সেনাবাহিনী ছাড়া দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে কেউই আন্তরিক নন। এবং কেউই নির্বাচন করার পক্ষে আন্তরিক নন। তাই এ মুহূর্তে দেশের বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান যে কোনো ফরম্যাটে দায়িত্ববান হিসেবে, তাদের তত্ত্বাবধানে মব ভায়োলেন্স-শূন্য, সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশের একটি স্থিতিশীল দেশ সৃষ্টি করতে পারেন। এবং দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন—সর্বোপরি রাজনীতি ও জনগণ যেন নিজ নিজ অবস্থানে শক্তিশালী হয়।

গত নয় মাস ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, একের পর এক প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—তা থেকে যেন দেশ মুক্তি পায়। কারণ, গত নয় মাসে দেশের তরুণ সম্প্রদায় ও ছাত্র সম্প্রদায়ের যে ক্ষতি হয়েছে, তার মূল্য কোটি কোটি পরিবারকে দীর্ঘকাল ধরে বহন করতে হবে। তাই ইতিহাসের এ অধ্যায়ে সেনাবাহিনী ও বিএনপিকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অনেক বড় দায় বহন করতে হবে।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

এ মুহূর্তে সেনাবাহিনী ও বিএনপির দায়ভার

০৮:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

যদিও বিষয়টি বেশ আগের থেকেই স্পষ্ট ছিলো, তারপরেও গত কয়েকদিনের ঘটনা আরও স্পষ্ট করেছে—বাংলাদেশকে মব-ভায়োলেন্সমুক্ত করা, বিভিন্ন এলাকা- ভিত্তিক বিশেষ মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের রাজত্ব থেকে বের করে আনা, ঢালাও চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘুদের ওপর সরব ও নীরব চলমান নির্যাতন বন্ধ করা, সর্বোপরি রাষ্ট্রের বেশিক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দূর করা, রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ পুলিশকে কার্যকর করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সময়মতো দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা—এখন একমাত্র সেনাপ্রধানের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

সেনাপ্রধান ও তাঁর ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর সর্বশেষ যে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরপরই দেশে একটি অতি নিম্নমানের (যাকে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ মানের বলা যায়) নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দেশের সচেতন জনগণ সবাই সেই নাটকের মূল কারণ বুঝে ফেলেছে।

এই নাটক কেন হলো এবং উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি—তাও এখন সবার কাছে পরিস্কার। কারণ, একটি শ্রেণীর কাছে ক্ষমতা ভোগের যে  সুখের অনুভূতি প্রবলভাবে কাজ করছে। তারা জানে যে কোনোভাবে ক্ষমতা ও ক্ষমতার চারপাশে না থাকলে এই সুখ তারা ভোগ করতে পারবে না।

আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে যারা সক্রিয়, তাদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি ছাড়া আর কারও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার কোনো শক্তি নেই। যেহেতু এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, তাই বিএনপির পরে বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। ক্যাডারভিত্তিক এই দলটি বিএনপির সমর্থন ছাড়া সর্বোচ্চ তিন থেকে পাঁচটি আসনে এখনও এদেশে নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেনি। অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কিছু ভোট আছে, তবে বিএনপির মতো দলের বিপরীতে তাদের কোনো আসনে জয়লাভ করার কোনো ক্ষমতা নেই। বরং যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং টাকার ছড়াছড়ি না থাকে, তাহলে অনেক স্বতন্ত্র ও  ভদ্র প্রার্থীর এলাকা- ভিত্তিক সুনামের কারণে জয়লাভ করার সম্ভাবনা আছে।

একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কখনো অনেকটা সহিংস, কখনো অহিংস আন্দোলন গত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি করেছে। আওয়ামী লীগও তাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন করেছে। বিএনপির নেতারা রাজবন্দির মতো বারবার জেলে গেছেন, আবার ফুলের মালা গলায় দিয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নিজেদের সংগঠন না গড়ে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন করে, মামলা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে বেশিক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতা স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের কালচার নষ্ট করে সমাজটাকে দুর্বৃত্তায়নের দিকে আরও ঠেলে দেয়। যে দুর্বৃত্তায়নের চরম প্রকাশ এখন বর্তমান ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটছে। যার ফলে দেশ আজ শুধু চরম নৈরাজ্যের দিকে এগুচ্ছে নয়, সেনাবাহিনী যদি এমন আন্তরিকভাবে এবং সমস্ত মান-অপমান সহ্য করে দায়িত্ব পালন না করতো—তাহলে দেশ এতদিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা শুধু স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কারণ, শুধুমাত্র দুর্বৃত্ত নয়, আমাদের সমাজের অনেকেই সচেতন বা অবচেতনভাবে কেন এই প্রাইভেট বাহিনীর মব ভায়োলেন্সকে সমর্থন করছে, তা সত্যিই ভবিষ্যতের বড় গবেষণার বিষয়।

৫ ফেব্রুয়ারি এই সরকারের সমর্থক, আমারও অতি আপনজন- একজনকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, “ভাই, দেশ কি এভাবে প্রাইভেট বাহিনী দিয়ে চলবে?” তিনি বলছিলেন, “দেশটি সৃষ্টির পর থেকে তো প্রাইভেট বাহিনী দিয়েই চলছে”। তার সে উত্তর শুনে আর কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। তাঁর মতো আমিও ’৬৯ এর গণঅভূত্থ্যান দেখেছি, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন দেখেছি। সব ক্ষেত্রেই ছাত্ররা অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন শেষে পড়াশোনায় বা নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে। কেউ কোনো প্রাইভেট বাহিনী তৈরি করেনি। আর এ দেশে মব ভায়োলেন্স তো একেবারেই নতুন।

যাহোক, দেশের যা পরিস্থিতি তা আমার থেকে দেশের প্রতিটি মানুষ আরও বেশি জানেন। তাই এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে দেশ যেদিকে এগুচ্ছে তা যে একটি ভয়াবহ দিক- সেটা সেনাপ্রধানের বক্তব্য ও সেনাবাহিনীর মুখপত্রের প্রেস ব্রিফিং থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেনাপ্রধান সেখান থেকে দেশকে ও দেশের শেষ সুসংগঠিত আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্যে অতি দ্রুত নির্বাচনের কথা বলেছেন।

সেনাপ্রধান বক্তব্যের পরে দেশে একটি নাটকও অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কেউ কেউ ওই নাটককে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার জন্যে বলছেন, বল এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের কোর্টে। আমি তা মনে করি না। কারণ ভোটে দাঁড়ালে তারা সবাই সর্বোচ্চ আড়াইশ থেকে তিনশ ভোটের মালিক। তাদের কট্টর সমর্থক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র একটি দল তিন-চারটে আসনে হয়তো জিততে পারে। তাও আওয়ামী লীগ না থাকলে, ত্রিমুখী ভোট না হলে—সেটাও ঘটবে না। এমত অবস্থায় বল এখন বিএনপির কোর্টে। আর মূল কাজটি এখন একমাত্র সম্পন্ন করতে পারেন সেনাপ্রধান ও তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেন যেন বিএনপি সেই বল সুন্দরভাবে খেলতে বা পাস দিতে পারছে না। এখান থেকে বেশ কয়েকমাস আগে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হলে তাঁকে ছোট একটা প্রশ্ন করেছিলাম, ৫ তারিখ সরকার পতনের পরে বড় দল ও ১৬ বছর ধরে আন্দোলন করা দল বিএনপি কেন ড্রাইভিং সিটে বসতে পারলো না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা বিশ্বাস করেছিলাম।” অনুষ্ঠান, তাই কথা বাড়াইনি। তবে রাজনীতিতে বিশ্বাস করা এক বিষয়, আর ড্রাইভিং সিটে বসা ভিন্ন বিষয়।

যাহোক, ৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক রাজনীতি যেখানে ছিলো বর্তমানে সেখানে নেই। তাছাড়া নয় মাসে পদ্মা-মেঘনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। যেহেতু আমার জন্ম হিন্দু ঘরে, তাই একটি বিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত, দেবতা বিসর্জন হয়ে গেলে তার মূর্তির শরীরের সমস্ত রঙ ও কাঁচা মাটি উঠে গেলে—নদী বা দীঘির জলে শুধুই বাঁশের গায়ে লাগানো খড়কুটোই ভাসতে থাকে। ওই বাঁশের গায়ে লাগানো খড়কুটো আর যাই হোক, দেবতা নন। বাংলাদেশের মানুষও নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে দেবতার শরীরের প্রকৃত খড়কুটোর রূপটি দেখে ফেলেছেন। বিএনপিও যে সেটা দেখে ফেলেছে, তার প্রমাণ তাদের নেতা আমীর খসরু মাহমুদ ও সালাউদ্দিন আহমদের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। তবে তার পরেও যেন বিএনপির ভেতর কোথায় একটা দ্বিধা কাজ করছে বলে দেশের সচেতন মানুষ মনে করছে।

তবে দেশের সামনে এখন এ সত্য এসে দাঁড়িয়েছে—দেশে যাতে নির্বাচন হয়, দেশ একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ঢুকে একটা নির্বাচন করতে পারে—সে কাজের একটি বড় দায়ভার জাতীয়ভাবে বিএনপির ওপর পড়েছে। এবং বিএনপি নেতারা রাজনীতিতে নিশ্চয়ই আমার মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তবে তারপরেও দেশের সামনে এখন এ বিষয়টি স্পষ্ট, একমাত্র সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী ছাড়া দেশের শক্তিশালী কোনো অংশ নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে নয়।

তাই বিএনপি সহ অন্যান্য যে রাজনৈতিক দল ও শক্তি এবং দেশের সাধারণ মানুষ যারা একটি সুন্দর নির্বাচন চান—তাদের সামনে এখন একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আর সে সিদ্ধান্তটিও স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেনাপ্রধান ও তাঁর সেনাবাহিনী ছাড়া দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে কেউই আন্তরিক নন। এবং কেউই নির্বাচন করার পক্ষে আন্তরিক নন। তাই এ মুহূর্তে দেশের বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান যে কোনো ফরম্যাটে দায়িত্ববান হিসেবে, তাদের তত্ত্বাবধানে মব ভায়োলেন্স-শূন্য, সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশের একটি স্থিতিশীল দেশ সৃষ্টি করতে পারেন। এবং দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন—সর্বোপরি রাজনীতি ও জনগণ যেন নিজ নিজ অবস্থানে শক্তিশালী হয়।

গত নয় মাস ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, একের পর এক প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—তা থেকে যেন দেশ মুক্তি পায়। কারণ, গত নয় মাসে দেশের তরুণ সম্প্রদায় ও ছাত্র সম্প্রদায়ের যে ক্ষতি হয়েছে, তার মূল্য কোটি কোটি পরিবারকে দীর্ঘকাল ধরে বহন করতে হবে। তাই ইতিহাসের এ অধ্যায়ে সেনাবাহিনী ও বিএনপিকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অনেক বড় দায় বহন করতে হবে।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.