“কিছু বাবা-মা শুধু একটিই সন্তান হারাননি… আমরা দেখেছি দুই বোন পাশাপাশি শুয়ে আছে কবরস্থানে, আর তাদের মা পাশে বসে কাঁদছেন।”
এই হৃদয়বিদারক কথা বলেছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি বর্ণনা করছিলেন মিয়ানমার জান্তা সরকারের সাম্প্রতিক এক বিমান হামলার কথা—যে হামলায় ২২ শিশু ও দুই শিক্ষক নিহত হন। এটি এমন বহু ঘটনার একটি, যেখানে আমরা অসংখ্য প্রাণহানির বর্ণনা পেয়েছি।
আমাদের দল দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের যুদ্ধাপরাধের ধারাবাহিকতা অনুসন্ধান ও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আসছে। আমরা বেসামরিক জনগণের ওপর লক্ষ্য করে পরিচালিত হামলা, বিশেষ করে বিমান হামলার বিশদ বিবরণ নথিভুক্ত করছি। সম্প্রতি, আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছি, যাতে এই অপরাধগুলোর প্রতি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়।
আমাদের নথিভুক্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১২ মে সাগাইং অঞ্চলের একটি স্কুলে ক্লাস চলাকালীন বিমান হামলা, যা সাম্প্রতিক এক ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি এলাকায় ঘটে। শুধু মৃত্যুই নয়, এই হামলায় অন্তত আরও ১০০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ওই স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, “অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে মরিয়া হয়ে স্কুলে পাঠান। কিন্তু এখন তারা শোকস্তব্ধ এবং আতঙ্কিত—এই নির্মম অভিজ্ঞতার পর তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না।”
জান্তা সরকারের এটাই চাওয়া। তাদের ধারণা, জনগণ যদি অশিক্ষিত থাকে, তবে তারা কখনো তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারবে না।
এই প্রাণঘাতী বিমান হামলা এমন এক সময়ে চালানো হয়েছে, যখন জান্তা সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ৩১ মে পর্যন্ত ‘যুদ্ধবিরতি’ বলবৎ থাকবে। এ ঘটনা পরিষ্কার করে দেয়, তারা নিজেরাই নিজেদের ঘোষিত যুদ্ধবিরতির শর্ত ও শিশুদের নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করছে। এসব বিমান হামলা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করছে এবং এগুলোর মূল লক্ষ্যই বেসামরিক জনগণ, কারণ এসব এলাকায় কোনো সামরিক ঘাঁটি বা সংঘর্ষ ছিল না।
আমি নিজে যেহেতু মিয়ানমারে অবস্থান করছি এবং জান্তা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য সংগ্রহ ও জবাবদিহিতার দাবি জানিয়ে আসছি, তাই আমি দেখেছি পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। আমরা যখনই স্থানীয় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি, কথাবার্তা মাঝপথে থেমে যায়, কারণ যুদ্ধবিমান উপরে চক্কর দিচ্ছে, আর মানুষকে দ্রুত আশ্রয়ে যেতে হচ্ছে। আমি স্পষ্টভাবে একজনের কথা মনে করতে পারি, যিনি বলেছিলেন, “তারা (যুদ্ধবিমান) ক্রমাগত উপরে ঘোরাঘুরি করছে, আমরা ভাবছি—পরবর্তী বোমাটিই হয়তো আমাদের জন্য।”
চীন ও রাশিয়া, যারা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা সরকারের প্রধান অস্ত্র ও জ্বালানির যোগানদাতা, তারা আধুনিক অস্ত্র ও বিমান জ্বালানি সরবরাহ করে চলেছে—ফলে এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে। এই বৈদেশিক সহায়তা একটি গণবিরোধী সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকম্পের পর বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের জনগণের জন্য সহানুভূতি দেখা গেলেও, জান্তা সরকারের নির্মমতা বন্ধ হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জান্তা সরকার প্রায়ই গ্রাম ও বেসামরিক এলাকা বোমা হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করে, মিথ্যা দাবি করে যে, সেসব এলাকায় সন্ত্রাসীরা অবস্থান করে বা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের প্রচার তাদের নিষ্ঠুরতা বৈধতা দিতে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই মিথ্যাচারের জবাব এখনই দৃঢ়ভাবে দিতে হবে—মৃতদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার স্বার্থেই। যারা এই পরিকল্পিত বিমান হামলা চালিয়েছে, তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের আওতায় আনতে হবে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলো ও আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলো এখনও জান্তার মিথ্যা বর্ণনাকে কার্যত মেনে নিচ্ছে এবং বিমান হামলার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস্থান নেয়নি।
ফোর্টিফাই রাইটসসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো, মিয়ানমারভিত্তিক সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—জান্তা সরকারের ওপর অবিলম্বে বিমান জ্বালানি ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। একই সঙ্গে, যেসব মানুষ সহায়তার প্রয়োজন তাদের কাছে বাধাবিহীন মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে।
মিয়ানমার সরকারের কাছে জ্বালানি না পৌঁছানো শুধু মানবিক বিষয় নয়, এটি একটি ভূরাজনৈতিক কৌশলও বটে—তাদের অবৈধ অভ্যুত্থানী ক্ষমতা ধ্বংসের লক্ষ্যে। জান্তা সরকারের ক্ষমতা মূলত আকাশপথে আধিপত্যের ওপর নির্ভরশীল—যার মাধ্যমে তারা নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে, জনগণকে আতঙ্কিত করে এবং বিরোধী শক্তিকে দমন করে। এই সুবিধা ছাড়া তারা কার্যত ভেঙে পড়বে, কারণ ইতোমধ্যে জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে তারা দেশটির তিন-চতুর্থাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, যারা আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে লড়ছে। তাই বিমান জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অপরাধ বন্ধ করার উপায় নয়, বরং এটি এই সংঘাতের মোড় ঘুরিয়ে মিয়ানমারকে একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।
আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মুখে শান্তি সংলাপের কথা থাকলেও বাস্তবে সেগুলো দাঁতহীন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা একটি জান্তা সরকারের হাতে যখন সাধারণ মানুষ নিপীড়নের শিকার হয়, তখন কেবল শব্দ দিয়ে নয়—নিরপেক্ষ তদন্ত ও আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মিয়ানমারের জনগণ অতীত ও বর্তমান যে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। এ ধরনের অব্যাহত বর্বরতা তাৎক্ষণিক আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দাবি করে, বিশেষ করে আসিয়ানকে এগিয়ে আসতে হবে—যার নিজস্ব নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থ জড়িত।
এখনই পদক্ষেপ না নিলে, এই সহিংসতা আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ও এই অন্যায়ের অংশীদার হয়ে উঠবে। তাই কূটনৈতিকভাবে সুপরিকল্পিত এবং ঐক্যবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখন অত্যাবশ্যক—মিয়ানমারের জনগণকে রক্ষা করার জন্য এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে।
লেখক: সাই আরকার (ছদ্মনাম), মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস-এর মানবাধিকার কর্মী