১২:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৭)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জুন ২০২৫
  • 82

নজরুল

কবির প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। বুলবুলের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বৎসর, তখনই কবি তাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতেন। অতটুকু ছেলে কী সুন্দর গান করিতে পারিত। কেমন মিষ্টি সুরে কথা বলিত। কবির কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া আমরা তার মুখের মিষ্টিকথা শুনিতাম। অতটুকু বয়সে ওস্তাদি গানের নানা সুর-বিভাগের সঙ্গে সে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। কবি হারমোনিয়ামে যখন কোনো সুর বাজাইতেন, বুলবুল শুনিয়াই বলিয়া দিতে

পারিত, কবি কোন সুর বাজাইতেছেন। বড় বড় মজলিশে খোকাকে লইয়া কবি বহুবার ইহার প্রমাণ দিয়াছেন। অতটুকু শিশুর সংগীতজ্ঞান দেখিয়া বড় বড় ওস্তাদেরা ধন্য ধন্য করিতেন। এই শিশুটিকে পাইয়া কবির ছন্নছাড়া জীবন কতকটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল।

করিকে আর কবি-পত্নীকে অনন্ত কান্নার সাগরে ডুবাইয়া সেই বেহেশতের বুলবুল পাখি বেহেশতে পালাইয়া গেল। কবির গৃহে শোকের তুফান উঠিল। কবি তাঁর বড় আদরের বুলবুলকে গোরের কাফন পরাইয়া মুসলিম প্রথা অনুসারে কবরস্ত করিয়াছিলেন। বুলবুলের যত খেলনা, তার বেড়াইবার গাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ সমস্ত কবি একঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন।

বুলবুলের মৃত্যুর সময় আমি কলিকাতা ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া কবি-গৃহে কবির অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম কবি ডি এম লাইব্রেরীতে গিয়াছেন। আমি সেখানে গিয়া কবিকে দেখিতে পাইলাম। তিনি এক কোণে বসিয়া হাস্যরসপ্রধান ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক কাব্যের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। পুত্রশোক ভুলিবার এই অভিনব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। কবির সমস্ত অঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দুটি কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। কবি দু-একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। এখনও আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারি না, কোন শক্তিবলে কবি পুত্রশোকাতুর মনকে এমন অপূর্ব হাস্যরসে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন। কবিতা লিখিবার স্থানটিও আশ্চর্যজনক। যাঁহারা তখনকার দিনে ডি এম লাইব্ররীর স্বল্পপরিসর স্থানটি দেখিয়াছেন, তাঁহারা সহজেই সেই পরিবেশটি অনুমান করিতে পারিবেন। দোকানে অনবরত বেচাকেনা হইতেছে, আর বাহিরের হট্টগোল কোলাহল-তার এক কোণে বসিয়া কবি রচনাকার্যে রত।

আমি এই সময় প্রায়ই কবির কাছে যাইয়া বসিয়া থাকিতাম। একদিন এক ভদ্রলোক একখানা চিঠি দিয়া গেলেন। চিঠিখানা পড়িয়া কবি অজস্রভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর রুমাল দিয়া চোখ মুছিয়া আবার চন্দ্রবিন্দু পুস্তকের হাস্যরসের গানগুলি লিখিতে মনোনিবেশ করিলেন। চিঠিখানা পড়িয়া দেখিলাম-ইহা লিখিয়াছেন কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু মোজাফফর আহমদ সাহেব জেল হইতে। বুলবুলের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া কবিকে এই পত্র লিখিয়া তিনি সমবেদনা জানাইয়াছেন। বুলবুলের মৃত্যুর পর তার শতচিহ্ন-জড়িত গৃহে কবির মন টিকিতেছিল না।

তাই ডি এম লাইব্রেরীর কোলাহলের মধ্যে আসিয়া কবি হাস্যরসের কবিতা লিখিয়া নিজের মনকে বুলবুলের চিন্তা হইতে সরাইয়া রাখিবার প্রয়াস করিতেছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, খোকার অসুখে অজস্র খরচ করিয়া এই সময়ে কবি ভীষণ আর্থিক অভাবে পড়িয়াছিলেন। ডি এম লাইব্রেরীতে আসিয়া প্রতিদিন কিছু কিছু লিখিয়া লাইব্রেরীর কর্মকর্তার নিকট হইতে কবি কিছু অর্থ লইয়া যাইতেন। অভাবের তাড়নায় এরূপ শোকতাপগ্রস্ত অবস্থায় কবি ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো অপূর্ব হাস্যরসের কাব্য রচনা করিয়াছেন। যদি তিনি মনের সুখে ‘সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ লিখিতে পারিতেন, তবে সেই লেখা আরও কত সুন্দর হইতে পারিত!

চলবে…..

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৭)

১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জুন ২০২৫

নজরুল

কবির প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। বুলবুলের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বৎসর, তখনই কবি তাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতেন। অতটুকু ছেলে কী সুন্দর গান করিতে পারিত। কেমন মিষ্টি সুরে কথা বলিত। কবির কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া আমরা তার মুখের মিষ্টিকথা শুনিতাম। অতটুকু বয়সে ওস্তাদি গানের নানা সুর-বিভাগের সঙ্গে সে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। কবি হারমোনিয়ামে যখন কোনো সুর বাজাইতেন, বুলবুল শুনিয়াই বলিয়া দিতে

পারিত, কবি কোন সুর বাজাইতেছেন। বড় বড় মজলিশে খোকাকে লইয়া কবি বহুবার ইহার প্রমাণ দিয়াছেন। অতটুকু শিশুর সংগীতজ্ঞান দেখিয়া বড় বড় ওস্তাদেরা ধন্য ধন্য করিতেন। এই শিশুটিকে পাইয়া কবির ছন্নছাড়া জীবন কতকটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল।

করিকে আর কবি-পত্নীকে অনন্ত কান্নার সাগরে ডুবাইয়া সেই বেহেশতের বুলবুল পাখি বেহেশতে পালাইয়া গেল। কবির গৃহে শোকের তুফান উঠিল। কবি তাঁর বড় আদরের বুলবুলকে গোরের কাফন পরাইয়া মুসলিম প্রথা অনুসারে কবরস্ত করিয়াছিলেন। বুলবুলের যত খেলনা, তার বেড়াইবার গাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ সমস্ত কবি একঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন।

বুলবুলের মৃত্যুর সময় আমি কলিকাতা ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া কবি-গৃহে কবির অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম কবি ডি এম লাইব্রেরীতে গিয়াছেন। আমি সেখানে গিয়া কবিকে দেখিতে পাইলাম। তিনি এক কোণে বসিয়া হাস্যরসপ্রধান ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক কাব্যের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। পুত্রশোক ভুলিবার এই অভিনব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। কবির সমস্ত অঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দুটি কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। কবি দু-একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। এখনও আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারি না, কোন শক্তিবলে কবি পুত্রশোকাতুর মনকে এমন অপূর্ব হাস্যরসে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন। কবিতা লিখিবার স্থানটিও আশ্চর্যজনক। যাঁহারা তখনকার দিনে ডি এম লাইব্ররীর স্বল্পপরিসর স্থানটি দেখিয়াছেন, তাঁহারা সহজেই সেই পরিবেশটি অনুমান করিতে পারিবেন। দোকানে অনবরত বেচাকেনা হইতেছে, আর বাহিরের হট্টগোল কোলাহল-তার এক কোণে বসিয়া কবি রচনাকার্যে রত।

আমি এই সময় প্রায়ই কবির কাছে যাইয়া বসিয়া থাকিতাম। একদিন এক ভদ্রলোক একখানা চিঠি দিয়া গেলেন। চিঠিখানা পড়িয়া কবি অজস্রভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর রুমাল দিয়া চোখ মুছিয়া আবার চন্দ্রবিন্দু পুস্তকের হাস্যরসের গানগুলি লিখিতে মনোনিবেশ করিলেন। চিঠিখানা পড়িয়া দেখিলাম-ইহা লিখিয়াছেন কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু মোজাফফর আহমদ সাহেব জেল হইতে। বুলবুলের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া কবিকে এই পত্র লিখিয়া তিনি সমবেদনা জানাইয়াছেন। বুলবুলের মৃত্যুর পর তার শতচিহ্ন-জড়িত গৃহে কবির মন টিকিতেছিল না।

তাই ডি এম লাইব্রেরীর কোলাহলের মধ্যে আসিয়া কবি হাস্যরসের কবিতা লিখিয়া নিজের মনকে বুলবুলের চিন্তা হইতে সরাইয়া রাখিবার প্রয়াস করিতেছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, খোকার অসুখে অজস্র খরচ করিয়া এই সময়ে কবি ভীষণ আর্থিক অভাবে পড়িয়াছিলেন। ডি এম লাইব্রেরীতে আসিয়া প্রতিদিন কিছু কিছু লিখিয়া লাইব্রেরীর কর্মকর্তার নিকট হইতে কবি কিছু অর্থ লইয়া যাইতেন। অভাবের তাড়নায় এরূপ শোকতাপগ্রস্ত অবস্থায় কবি ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো অপূর্ব হাস্যরসের কাব্য রচনা করিয়াছেন। যদি তিনি মনের সুখে ‘সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ লিখিতে পারিতেন, তবে সেই লেখা আরও কত সুন্দর হইতে পারিত!

চলবে…..