নজরুল
একদিন মহাত্মা গান্ধির সামনে নজরুল তাঁর ‘ঘোর ঘোর ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর’ গানটি গাহিলেন। গান্ধিজি গান শুনিয়া হাসিয়া কুটিকুটি। কনফারেন্স শেষ হইলে কবি আবার আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবি স্থির করিলেন, তিনি এখানে বসিয়া ‘বালুচর’ নামে একখানা বই লিখিবেন। কিছুদিন কবির সঙ্গে কাটাইতে পারিব, এই আশায় মন পুলকিত হইয়া উঠিল।
কিন্তু অল্পদিন পরে পাবনার এক ভদ্রলোক আসিয়া কবিকে চিলের মতো ছোঁ মারিয়া লইয়া গেলেন। যাইবার সময় কবি কথা দিয়া গেলেন, ফিরিবার সময় আবার আমার এখানে আসিবেন। কবির বাজেয়াপ্ত বইগুলির কিছু আমার কাছে রাখিয়া গেলেন। কিন্তু কবি আর ফিরিয়া আসিলেন না। বহুদিন পরে কবি চিঠি লিখিলেন, বইগুলির কিছু যদি বিক্রয় হইয়া থাকে তবে আমি যেন সত্বর তাঁহাকে টাকাটা পাঠাইয়া দিই। কবির অসুখ। অর্থের খুব টানাটানি। কিন্তু বাজেয়াপ্ত বই কেহ কিনিতে চাহে না। পুলিশে ধরা পড়িবার ভয় আছে। কিছুই বিক্রয় করিতে পারি নাই। তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে গ্রাম্য-গান সংগ্রহের জন্য মাসে সত্তর টাকা করিয়া পাইতাম। সেই টাকা হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ কবির নিকট মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইলাম।
একবার কলিকাতা গিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিতে তাঁহার বাসায় যাই। কবি তখন বিবাহ করিয়া সদ্য সংসার পাতিয়াছেন। হাস্যরসিক নলিনী সরকার মহাশয়ের বাসায় তিনি থাকেন। কবি আমাকে শয়ন-গৃহে ডাকিয়া পাঠাইলেন। নতুন ভাবির সঙ্গে কবি লুডো খেলিতেছিলেন।
ভাবির সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিয়া কবি আমাকেও খেলিতে আহ্বান করিলেন। আমি অনেকক্ষণ তাঁহাদের সঙ্গে খেলিলাম। ভাবির সেই রাঙা-টুকটুকে মুখের মধুর হাসিটি আজও আমার মনে আছে। তখন কবির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কবি-প্রিয়া কিন্তু আমাকে না খাইয়া আসিতে দিলেন না। আমি কবির কোনো রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় নই। তবু কবি আমাকে আপন ভাই-এর মতো তাঁর গৃহের একজন করিয়া লইলেন। এরপর যখনই কবিগৃহে গমন করিয়াছি, কবিপত্নীর ব্যবহারে তাঁদের গৃহখানি আমার আপন বলিয়া মনে হইয়াছে।
আমি তখন মেছুয়াবাজারে ওয়াই এম সি এ হোস্টেলে থাকিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ পড়ি। আমাদের হোস্টেলে মাঝে মাঝে নানারকম উৎসব-অনুষ্ঠান হইত। তাহাতে হোস্টেলের ছাত্রেরা নিজেদের আত্মীয়া মহিলাদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতেন। কলিকাতায় আমার নিকট-আত্মীয়া নাই, আমি আর কাহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিব। একদিন সেই কথা ভাবিকে বলিলাম। ভাবি অতি সহজেই আমাদের হোস্টেলে আসিতে রাজি হইলেন। ভাবির মা, খালাম্মাও সঙ্গে আসিলেন। উৎসব-সভায় তাঁহারা আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন ভাবিকে দেখিবার জন্য ছাত্রমহলের মধ্যে সাড়া পড়িয়া গেল। আমার মনে হয়, কবিগৃহিণীর জীবনে বাহিরের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এই প্রথম।
ভাবির মতন এমন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুবই কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া নোঙরহীন জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহ-মমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কবির কাব্যসাধনাকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। কোনো সময় তাঁহাকে কবির সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করিতে দেখি নাই। প্রথম জীবনে কবি ভাবিকে বহু সুন্দর পত্র লিখিয়াছিলেন। ভাবি সেই পত্রগুলি যক্ষের ধনের মতো রক্ষা করিতেন। একদিন ভাবিকে বলিলাম, “ভাবি, আমি আপনার ভাই। যদি ভরসা দেন তো একটা অনুরোধ আপনাকে করব।”
ভাবি হাসিয়া উত্তর করিলেন, “কী অনুরোধ, বলো তো ভাই?”
আমি বলিলাম, “কবিভাই আপনাকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তার দু-একখানা যদি আপনি আমাকে দেখান।”
ভাবির চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। সামনে খালাআম্মা বসিয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন, “বাবা। সেসব চিঠি কি ওর কাছে আছে? একবার কি-একটা সামান্য কারণে নুরু রাগ করে সবগুলি চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছে।”
চলবে…..