০২:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
ঢাকা-খুলনাসহ ১৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ ব্যাংকঅ্যাশিওরেন্স: শোকাহত পরিবারের পাশে দ্রুত সহায়তা মুজিব ‘স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি’, হাসিনা ‘বাকশাল আদর্শের অনুসারী’: সালাহউদ্দিন ব্র্যাক ব্যাংক ও আইডিকলের যৌথ অর্থায়নে পাবনায় ৬৪.৫৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ইসলামী ব্যাংকের সহযোগিতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হচ্ছে অনলাইন ফি পরিশোধের যুগ হবিগঞ্জে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে কলেজছাত্রী আটক চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে এক ব্যক্তির মৃত্যু পাকিস্তানের জয়গান: আবরারের ঘূর্ণিতে বিধ্বস্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, ২–১ ব্যবধানে সিরিজ জয় রমনা গির্জায় ককটেল হামলায় উদ্বেগ: খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান কেন পৃথিবী জুড়ে ঘূর্ণিঝড় আগের থেকে বেশি হচ্ছেঃ বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও জাপান বিপদের মুখে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
  • 259

নজরুল

বাঁশঝাড়ের যে স্থানটিতে কবির বসিবার আসন পাতিয়া দিয়াছিলাম সেই স্থান শূন্য পড়িয়া রহিল। চরের বাতাস আছাড়িবিছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। আমার নদীতীরের কুটিরে কবির এই শেষ আগমন।

একদিন রাত্রে বন্ধুবর লাল মিঞার বাড়িতে আমরা তিন-চার জন মিলিয়া কবির সঙ্গে গল্প করিতে বসিলাম। কবি ভালো কবিতা লেখেন ভালো বক্তৃতা দেন, ভালো গান করেন-তাহা সকলেই জানেন। কিন্তু মজলিশে বসিয়া যাঁহারা কবির গালগল্প না শুনিয়াছেন, তাঁহারা কবির সব চাইতে ভালো গুণটির পরিচয় পান নাই। অনেক বড় বড় লোকের মজলিশে কবিকে দেখিয়াছি। মজলিশি গল্পে বিখ্যাত দেশবরেণ্য নেতা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গেও কবিকে দেখিয়াছি, সেখানেও একমাত্র কথক কবি-আর সকলেই শ্রোতা।

কথায় কথায় কবির সে কী উচ্চ হাসি আর সেই হাসির তুফানে আশেপাশের সমস্ত লোক তাঁর হাতের পুতুলের মতো একবার উঠিতেছে, একবার পড়িতেছে। কিন্তু এইদিন রাত্রে কবিকে যেন আরও নতুন করিয়া পাইলাম। কবির মুখে গল্প শুনিতে শুনিতে মনে হইল, কবির সমস্ত দেহটি যেন এক বীণার যন্ত্র। আমাদের দু-একটি প্রশ্নের মৃদু করাঘাতে সেই বীণা হইতে অপূর্ব সুরঝঙ্কার বাহির হইতেছে। কবি বলিয়া যাইতে লাগিলেন তাঁহার সমস্ত জীবনের প্রেমের কাহিনী। বলিতে বলিতে কখনও কবি আমাদের দুই চোখ অশ্রু-ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছেন, আবার কখনও আমাদিগকে হাসাইয়া প্রায় দম বন্ধ করিবার উপক্রম করিয়া তুলিতেছেন। সে সব গল্পের কথা আজও বলিবার সময় আসে নাই।

গল্প শুনিতে শুনিতে কোন দিক দিয়া যে ভোর হইয়া গেল, তাহা আমরা টেরও পাইলাম না। সকালবেলা আমরা কবিকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম।

একবার কবিকে আর একটি সভায় খুব গল্পমুখর দেখিয়াছিলাম। কবির এক গানের শিষ্যা পুষ্পলতা দে’র জন্মদিনে। সেই সভায় জাহানারা বেগম, তাঁহার মা, কবির শ্বাশুড়ি এবং কবি-পত্নী উপস্থিত ছিলেন।

আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। ছোট ছোট মাটির পাত্রে করিয়া নানা রকম খাদ্যবস্তু আমাদের সামনে আনিয়া দেওয়া হইতেছে। কবি তার এক একটি দেখাইয়া বলিতেছেন-এটি খুড়িমা, এটি পিসিমা, এটি মাসিমা।

আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা কবিভাই। সবাইকে দেখালেন-আমার ভাবি কোনটি তাঁকে তো দেখালেন না?”

কবি একটুও চিন্তা না করিয়া পানির গেলাসটি দেখাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এইটি তোমাদের ভাবি। যেহেতু আমি তাঁহার পাণি-গ্রহণ করেছি।”

চারিদিকে হাসির তুফান উঠিল। ভাবি হাসিয়া কুটিকুটি হইলেন। কোনো রকমে হাসি থামাইয়া আমরা আবার আহারে মনোনিবেশ করিয়াছি অমনি কবি গম্ভীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “জসীম, তুমি লুচি খেও না।”

বাড়ির গৃহিণীর মুখ ভার। না জানি লুচির মধ্যে কবি কোন ত্রুটি পাইয়াছেন। আমি উত্তর করিলাম, “কেন কবি ভাই?” সকলেই ভোজন ছাড়িয়া কবির দিকে চাহিলেন।

কবি বলিয়া উঠিলেন, “যেহেতু আমরা বেলুচিস্তান হতে এসেছি, সুতরাং লুচি খেতে পারব না।”

চারিদিকে আবার হাসির তুফান উঠিল। সেদিন কবি আমাদিগকে এত হাসাইয়াছিলেন যে, হাসির চোটে অনেকেরই খাদ্যবস্তু গলায় আটকাইয়া যাইতেছিল।

বাড়ির গৃহিণী কৃত্রিম গলবস্ত্র হইয়া কবিকে বলিলেন, “বাবা নুরু, লক্ষ্মীটি! তুমি একটু-ক্ষণের জন্য হাসির কথা বন্ধ কর। এঁদের খেতে দাও।”

আগেই বলিয়াছি, বিষয়বুদ্ধি কবির মোটেই ছিল না। একবার কবির বাড়ি গিয়া দেখি, খালা-আম্মা কবিকে বলিতেছেন, “ঘরে আর একটিও টাকা নেই। কাল বাজার করা হবে না।”

 

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢাকা-খুলনাসহ ১৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০২)

১১:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

নজরুল

বাঁশঝাড়ের যে স্থানটিতে কবির বসিবার আসন পাতিয়া দিয়াছিলাম সেই স্থান শূন্য পড়িয়া রহিল। চরের বাতাস আছাড়িবিছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। আমার নদীতীরের কুটিরে কবির এই শেষ আগমন।

একদিন রাত্রে বন্ধুবর লাল মিঞার বাড়িতে আমরা তিন-চার জন মিলিয়া কবির সঙ্গে গল্প করিতে বসিলাম। কবি ভালো কবিতা লেখেন ভালো বক্তৃতা দেন, ভালো গান করেন-তাহা সকলেই জানেন। কিন্তু মজলিশে বসিয়া যাঁহারা কবির গালগল্প না শুনিয়াছেন, তাঁহারা কবির সব চাইতে ভালো গুণটির পরিচয় পান নাই। অনেক বড় বড় লোকের মজলিশে কবিকে দেখিয়াছি। মজলিশি গল্পে বিখ্যাত দেশবরেণ্য নেতা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গেও কবিকে দেখিয়াছি, সেখানেও একমাত্র কথক কবি-আর সকলেই শ্রোতা।

কথায় কথায় কবির সে কী উচ্চ হাসি আর সেই হাসির তুফানে আশেপাশের সমস্ত লোক তাঁর হাতের পুতুলের মতো একবার উঠিতেছে, একবার পড়িতেছে। কিন্তু এইদিন রাত্রে কবিকে যেন আরও নতুন করিয়া পাইলাম। কবির মুখে গল্প শুনিতে শুনিতে মনে হইল, কবির সমস্ত দেহটি যেন এক বীণার যন্ত্র। আমাদের দু-একটি প্রশ্নের মৃদু করাঘাতে সেই বীণা হইতে অপূর্ব সুরঝঙ্কার বাহির হইতেছে। কবি বলিয়া যাইতে লাগিলেন তাঁহার সমস্ত জীবনের প্রেমের কাহিনী। বলিতে বলিতে কখনও কবি আমাদের দুই চোখ অশ্রু-ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছেন, আবার কখনও আমাদিগকে হাসাইয়া প্রায় দম বন্ধ করিবার উপক্রম করিয়া তুলিতেছেন। সে সব গল্পের কথা আজও বলিবার সময় আসে নাই।

গল্প শুনিতে শুনিতে কোন দিক দিয়া যে ভোর হইয়া গেল, তাহা আমরা টেরও পাইলাম না। সকালবেলা আমরা কবিকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম।

একবার কবিকে আর একটি সভায় খুব গল্পমুখর দেখিয়াছিলাম। কবির এক গানের শিষ্যা পুষ্পলতা দে’র জন্মদিনে। সেই সভায় জাহানারা বেগম, তাঁহার মা, কবির শ্বাশুড়ি এবং কবি-পত্নী উপস্থিত ছিলেন।

আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। ছোট ছোট মাটির পাত্রে করিয়া নানা রকম খাদ্যবস্তু আমাদের সামনে আনিয়া দেওয়া হইতেছে। কবি তার এক একটি দেখাইয়া বলিতেছেন-এটি খুড়িমা, এটি পিসিমা, এটি মাসিমা।

আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা কবিভাই। সবাইকে দেখালেন-আমার ভাবি কোনটি তাঁকে তো দেখালেন না?”

কবি একটুও চিন্তা না করিয়া পানির গেলাসটি দেখাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এইটি তোমাদের ভাবি। যেহেতু আমি তাঁহার পাণি-গ্রহণ করেছি।”

চারিদিকে হাসির তুফান উঠিল। ভাবি হাসিয়া কুটিকুটি হইলেন। কোনো রকমে হাসি থামাইয়া আমরা আবার আহারে মনোনিবেশ করিয়াছি অমনি কবি গম্ভীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “জসীম, তুমি লুচি খেও না।”

বাড়ির গৃহিণীর মুখ ভার। না জানি লুচির মধ্যে কবি কোন ত্রুটি পাইয়াছেন। আমি উত্তর করিলাম, “কেন কবি ভাই?” সকলেই ভোজন ছাড়িয়া কবির দিকে চাহিলেন।

কবি বলিয়া উঠিলেন, “যেহেতু আমরা বেলুচিস্তান হতে এসেছি, সুতরাং লুচি খেতে পারব না।”

চারিদিকে আবার হাসির তুফান উঠিল। সেদিন কবি আমাদিগকে এত হাসাইয়াছিলেন যে, হাসির চোটে অনেকেরই খাদ্যবস্তু গলায় আটকাইয়া যাইতেছিল।

বাড়ির গৃহিণী কৃত্রিম গলবস্ত্র হইয়া কবিকে বলিলেন, “বাবা নুরু, লক্ষ্মীটি! তুমি একটু-ক্ষণের জন্য হাসির কথা বন্ধ কর। এঁদের খেতে দাও।”

আগেই বলিয়াছি, বিষয়বুদ্ধি কবির মোটেই ছিল না। একবার কবির বাড়ি গিয়া দেখি, খালা-আম্মা কবিকে বলিতেছেন, “ঘরে আর একটিও টাকা নেই। কাল বাজার করা হবে না।”

 

চলবে…..