নজরুল
নজরুলের আগমনের পর হইতে গ্রামোফোন কোম্পানি আরও নূতন নূতন রচনাকারীর সন্ধানে ছুটিল, নূতন নূতন সুর-সংযোজনাকারের খোঁজে বাহির হইল। নজরুলের রচনা আর সুর লইয়া তাহারা বুঝিতে পারিল, সুন্দর কথার সঙ্গে সুন্দর সুরের সমাবেশ হইলে সেই গান বেশি লোকপ্রিয় হয়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে আজ যে এত কথাকার আর এত সুরকার গুঞ্জরণ করিতেছেন, এ শুধু নজরুলের জন্য। একথা কি তাঁহারা কেহ আজ স্বীকার করিবেন?
একটি গান রচনা করা অনেক সময় একটি মহাকাব্য রচনার সমান। মহাকাব্যের লেখক সুবিস্তৃত কাহিনীর পটক্ষেপের মধ্যে আপনার ভাব রূপায়িত করিবার অবসর পান; গানের লেখক মহাকাব্য রচনা করেন অতি সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথার ভিতর দিয়া: মহাকাব্যের পাঠক বার বার সেই কাব্য পাঠ করেন না। করিলেও সেই কাব্যের ত্রুটিবিচ্যুতির সন্ধান সহজে পান না। কিন্তু গানের সমঝদার গানটিকে বার বার করিয়া আবৃত্তি করিয়া সেই গানের পুঙ্খানুপুগ্ধ ত্রুটিবিচ্যুতি ও গুণের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই জন্য একটি ভালো গান রচনা করা প্রায় একটি মহাকাব্য রচনার মতোই কঠিন। নজরুলের বেলায় দেখিয়াছি, গান রচনা তাঁহার পক্ষে কত সহজ ছিল। তিনি যেন গান রচনা করেন নাই, বালকের মতো গানের পুতুল লইয়া খেলা করিতেন। সুরগুলি পাখির মতো সহজেই তাঁহার কথার জালে আসিয়া আবদ্ধ হইয়াছে।
গ্রামোফোন-কোম্পানিতে গিয়া বহুদিন কবিকে গান রচনা করিতে দেখিয়াছি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এ ঘরে-ও ঘরে গায়কেরা নানা রাগ-রাগিণী ভাঁজিয়া সুরাসুরের লড়াই বাধাইয়া তুলিয়াছেন, কানে তালা লাগিবার উপক্রম। মাঝখানে কবি বসিয়া আছেন হারমোনিয়াম সামনে লইয়া। পার্শ্বে অনেকগুলি পান আর পেয়ালাভরা গরম চা। ছয়-সাত জন গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়। একজনের চাই দুইটি শ্যামাসঙ্গীত, অপরের চাই একটি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কীর্তন, একজনের চাই দুইটি ইসলামি সঙ্গীত, অন্যজনের চাই চারটি ভাটিয়ালি গান আর অন্যজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বসিয়া আছেন। কবি তাঁহার মানসলোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাঁদের করপুট ভরিয়া দিবেন।
কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন আর গুনগুন করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাত-আটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না-তাহাতে সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে। কবির কাব্যের মধ্যে বহু স্থানে বাজে উচ্ছ্বাস ও অসংযমের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু গানের স্বল্পপরিসর আয়তনের মধ্যে আসিয়া কবির রচনা যেন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। কবি যেন তাঁহার গানের ক্ষুদ্র কৌটার মধ্যে মহাকাশের অনন্ত রহস্য জুড়িয়া দিয়াছেন। সেই গান যতই গাওয়া যায়, তাহা হইতে ততই মাধুর্যের ইন্দ্রজাল বিস্তৃত হইতে থাকে। কবির যে গানে রচনার মাধুর্য পাওয়া যায় না, সুরের মাধুর্য সেখানে রচনার দৈন্য পুরণ করে। কবি যখন সাহিত্য করিয়াছেন, সেই সাহিত্যকে তিনি জনসাধারণের উপভোগ্য করিয়া তুলিয়াছেন।
সাহিত্য করিতে করিতে কবি যখন জেলে গেলেন, সেখানেও আত্মসম্মানের মহিমা লইয়া কবি সমস্ত দেশের অন্তর জয় করিয়াছেন। চল্লিশ দিন ব্যাপী অনশনের সুদীর্ঘ বন্ধুর-পথে এই নির্ভীক সেনানী প্রতি পদক্ষেপে তাঁহার দেশবাসীর অন্তর উদ্বেলিত করিয়া তুলিয়াছেন। ইদানীং রোগের শর-শয্যায় শয়ন করিয়া কবি দেশবাসীর অন্তরে আরও সমুজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করিতেছেন।
কবিকে আমি শেষবার সুস্থ অবস্থায় দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনিলাম মুসলিম-হলে কবি আসিবেন ভোর আটটায়। কিন্তু কবি আসিলেন বেলা দশটায়। সময়ানুবর্তিতার জ্ঞান কবির কোনোদিনই ছিল না। নোঙরহীন নৌকায় যে-কেহ আসিয়া হাল ঘুরাইয়া কবির গতি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিত। এক জায়গায় যাইবার জন্য তিনি যাত্রা করিলেন, তাহার গুণগ্রাহীরা তাঁহাকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য স্থানে লইয়া গেলেন। এজন্য কবিকেই আমরা দায়ী করিয়া থাকি। যবনিকার অন্তরালে যাঁহারা কবিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেন, তাঁহারা কোনোদিনই দায়ী হইবেন না। শিশুর মতো আপনভোলা কবিকে সেজন্য কত লোকের বিরাগভাজন হইতে হইয়াছে।
চলবে…..