সপ্তম পরিচ্ছেদ
গাড়ি থামল। চুবুক তাড়াতাড়ি পাইপটা পকেটে পুরে ফেলে চুপিচুপি বললেন: ‘শব্দ শুনে মনে লিচ্ছে সামনে কী যেন ধবধবিয়ে আসচে। রাইফেলটা দ্যাও দিকি।’
আহত যাত্রীসহ ঘোড়া আর গাড়ি সবকিছু রাস্তা থেকে নামিয়ে ঝোপের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। গাড়ির কাছে আমাকে রেখে চুবুক অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একটু পরেই ফিরলেন তিনি।
‘চুপ, একটা কথাও না… চারটে ঘোড়সওয়ার কসাক। আমারে এটা বস্তা দ্যাও দেখি। ঘোড়ার মুখটা ভালো করে ঢেকে দিই, পাছে আবার ডেকে-ডুকে ওঠে।’
ঘোড়ার খুরের খপথপ শব্দ কাছে এগিয়ে এল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলুম তারই কাছাকাছি এসে কসাকরা ঘোড়াগুলোর গতি কমিয়ে দুলকি চালে চলতে লাগল। এক টুকরো ছোঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে একফালি চাঁদের রূপোলি আলো রাস্তাটা আলো করে তুলেছিল। ঝোপের আড়াল থেকে চারটে পাপাখা-টুপি নজরে পড়ল আমার। কসাকদের মধ্যে একজন ছিল অফিসার। তার কাঁধে-আঁটা সোনালী পট্টি এক ঝলক দেখতে পেলুম। ঘোড়ার পায়ের শব্দ যতক্ষণ-না মিলিয়ে গেল ওই জায়গায় অপেক্ষা করে রইলুম আমরা, তারপর ফের রওনা দিলুম।
খামারে গিয়ে পৌঁছলুম যখন, তখন সবে ভোর হচ্ছে।
ঘোড়াগাড়ির শব্দ পেয়ে মৌমাছি-পালক ঘুমচোখে খামারের সদর দরজায় এসে
দেখা দিলেন। লোকটি রোগা, লম্বা, লাল চুলওয়ালা এক চাষী। বুকটা চুপসে যাওয়া আর বোতাম-খোলা সূতী কামিজের তলা থেকে তাঁর কাঁধের হাড় দুটো অস্বাভাবিক ঠেলে উঠেছিল। ঘোড়াটাকে খামারবাড়ির উঠোন পার করে তারপর অপর একটা ছোট গেটের ভেতর দিয়ে ঘাসে-ঢাকা, বোঝা-যায়-কি-যায়-না এমন একটা পায়ে-চলা পথের ওপর এনে ফেললেন। বললেন:
‘ওইখেনে যাব আমরা। জলার ধারে জঙ্গলের মধ্যি ফসল-মাড়াইয়ের চালা আছে একখান। ওরা ওইখেনে নিশ্চিন্দিতে থাকবে।’
ছোট্ট চালাঘরখানা ছিল, খড় দিয়ে ঠাসা, তবে ঠান্ডা আর খুব নিস্তদ্ধন্ধ। ঘরের পেছনের একটা কোণে চটের কাপড় পেতে দেয়া হল। বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে দুটো ভেড়ার চামড়া ভাঁজ করে মাথার নিচে দেয়া হল। কাছেই রইল এক বালতি জল, আর বার্চের বাকল-দিয়ে-তৈরি পাত্রে খানিকটা কুভাস।