সপ্তম পরিচ্ছেদ
অসম্ভব মনঃক্ষুন্ন হলুম আমি। চুবুকের কথাগুলো আমাকে অত্যন্ত আঘাত দিয়েছিল, তাই চুপ করে গেলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ আবার চুপ করে থাকতে পারলুম না।
‘তাহলে, চুবুক, আমার আর এ-বাহিনীতে থাকার দরকার কী? আমি যদন কাদেত হতে পারতুম, কালেদিন-ওয়ালা হতে পারতুম…’
‘গাধা কোথাকার!’ শান্তভাবে চুবুক বললেন। মনে হল, আমি যে এতটা মনঃক্ষর হয়েছি তা যেন উনি লক্ষ্যই করেন নি। ‘কী তুমি হতি পারতে তা লিয়ে কার মাথাব্যথা পড়েচে। তুমি এখন কী, সেই হল গিয়ে আসল কথা। তোমারে আমি এ-সব কথা কেন কচ্চি জান তো, পাছে তোমার মাথা গরম হয় সেই জন্যি। তবে সব সত্ত্বেও কইতে হয়, ছেলেটা তুমি খারাপ লও। আরও ভালো করে তোমারে চেনলে জানলে পর কেমে তোমারে পার্টিতেও লিয়ে লিতে পারি। বোকা ছেলে কোথাকার!’ এবার একটু নরম গলায় বললেন উনি।
আমি জানতুম চুবুক আমায় পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি কি বুঝতে পারছিলেন যে সেই মুহূর্তে কতখানি আকুলভাবে, দুনিয়ায় আর সকলের চেয়ে কত বেশি, আমি তাঁকে ভালোবেসেছিলুম? মনে মনে বললুম, ‘চুবুক বড় ভালো লোক। মনে রাখতে হবে, তিনি একজন কমিউনিস্ট, দীর্ঘ কুড়ি বছর কাটিয়েছেন খনি-অঞ্চলে, তাঁর চুলে পাক ধরেছে, আর সেই তিনিই আমাকে সর্বদা কাছে-কাছে রাখেন। একা আমার সঙ্গে থাকেন। এর অর্থ, আমি এর যোগ্য। এর যোগ্য হয়ে থাকার আরও বেশি করে চেষ্টা করতে হবে আমাকে।
এর পরে যখন আবার সামনাসামনি যুদ্ধ হবে, গুলি আসছে দেখলে তখন আমি ইচ্ছে করেই মাথা লুকোর না। মারা পড়লে পড়ব, কে তোয়াক্কা করে! তাহলে ওরা আমার বাড়িতে মা-র কাছে চিঠি লিখবে: ‘আপনার ছেলে ছিল কমিউনিস্ট। বিপ্লবের মহান প্রয়োজনে সে প্রাণবলি দিয়েছে।’ খবর পেয়ে মা কাঁদবেন, তারপর আমার ছবিটা বাবার ছবির পাশে দেয়ালের গায়ে টাঙিয়ে রাখবেন। আর সেই দেয়ালের ওপারে এক নতুন সুখের জীবন স্বাভাবিকভাবে বয়ে যেতে থাকবে।’
‘পাদ্রিরা যে মানুষের আত্মা সম্বন্ধে মিথ্যে গল্প রটিয়ে থাকে, এটা দুঃখের কথা,’ আমি ভাবলুম। ‘আসলে মানুষের আত্মা বলে আলাদা কিছু নেই। কিন্তু সত্যিই যদি তার আত্মা বলে কিছু থাকে, তাহলে যে-জীবন আসছে সেটা সেই আত্মার আগে থেকে দেখতে পাওয়া উচিত। মনে হচ্ছে, সেই জীবনটা ভালোই হবে, বেশ মজাদার হবে।’