সপ্তম পরিচ্ছেদ
যে-জঙ্গলের পথে আমরা তখন যাচ্ছিলুম সেটা আসলে ছিল ছোট্ট একটা বন। কিন্তু সেই বিরল-গাছপালা, অর্ধেক কেটে সাফ-করে-ফেলা বনটাকেই তখন আমাদের কাছে আদিম, দুর্ভেদ্য এক জঙ্গল বলে বোধ হচ্ছিল। রাস্তার দু-পাশে গাছের সারির মাঝখানটাতে মেঘে-ঢাকা আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কালো একটা ঘরের ছাদের মতো সেটা নিচু হয়ে এসেছে। আবহাওয়া ছিল গুমোট। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন একটা লম্বা আঁকাবাঁকা বারান্দা ধরে হাতড়ে-হাতড়ে চলেছি।
যেতে-যেতে এই রকম অনেক দিন আগেকার আরেক গরমকালের রাত্তিরের কথা মনে পড়ল আমার। সে বোধহয় আরও বছর তিনেক আগেকার কথা হবে। বাবা আর আমি সে-রাত্রে রেলস্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে সোজা রাস্তায় যাচ্ছিলুম। সেদিন সে-পথেও এমনি শোনা যাচ্ছিল চাতকের কান্না আর নাকে আসছিল এমনি বেশি-পাকা ব্যাঙের ছাতা আর বুনো রাস্কেরির গন্ধ।
সেদিন রেলস্টেশনে ভাই পিয়োত্রকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে বাবা ছোট গেলাসের কয়েক গেলাস ভোল্কা খেয়েছিলেন। সেই জন্যেই, নাকি রাস্পবেরির মিষ্টি গন্ধে, তা ঠিক জানি না, বাবা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন আর কথা বলছিলেন অনর্গল। বাড়ি ফেরার পথে তাঁর নিজের অল্প বয়সের কথা আর সেমিনারিতে পড়াশুনোর গল্প বলছিলেন। মনে পড়ে তাঁর ইশকুল-জীবনের কাহিনী আর বার্চ-গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে কীভাবে তাঁদের বেত মারা হত সেই সব কথা শুনতে-শুনতে খুব হাসছিলুম।
আমার বাবার মতো অমন একজন লম্বা-চওড়া জোয়ান লোককে যে কেউ বেত মারতে পারে এটা কেমন হাস্যকর আর অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। ‘বললেই হল, এ তোমার নিজের কথা নয়। নিশ্চয়ই কোথাও এ-বিষয়ে পড়ে বলছ,’ আমি বলেছিলুম ‘কার যেন একখানা বই আছে না, তাতে এ-সব লেখা আছে। বইটার নাম ‘সেমিনারির রূপরেখা’। কিন্তু ও তো কোন্ আদ্যিকালের কথা!’
‘তুমি কি ভাবছ আমি বেশিদিন আগে পড়াশুনো করি নি? সেই কোনকালে লেখাপড়া শিখেছি আমি।’
‘তুমি তো সাইবেরিয়ায়ও থেকেছ, বাপি। নিশ্চয়ই খুব সাংঘাতিক জায়গা সাইবেরিয়া, দ্বীপান্তরের কয়েদীতে গিজগিজ করছে একেবারে। তাই না? পেত্কার কাছে শুনেছি, ওখানে নাকি যে-কোনো লোক খতম হয়ে যেতে পারে, আর সেজন্যে নালিশ জানানোরও কেউ নেই।’