পুরান ঢাকার ঈদ মানে শুধু একটি দিনের উৎসব নয়—এটি তিন দিন, কখনো বা পুরো সপ্তাহজুড়ে চলা এক ধারাবাহিক মিলনমেলা, স্বাদ-স্মৃতি-সংস্কৃতির মিশেল। ঈদের দিন দুপুর-রাতের রাজকীয় ভোজের পর, ঈদের দ্বিতীয় দিনেও রান্নাঘর থেমে থাকে না। বরং এই দিনেই তৈরি হয় এমন সব পদ, যেগুলোর স্বাদ অন্যরকম, রান্নার ধরন বেশি ঘরোয়া, আর স্মৃতির রঙ একটু বেশি ব্যক্তিগত। বাকি থাকা কোরবানির মাংস দিয়ে পুরান ঢাকার বাড়িতে তৈরি হয় নতুন নতুন পদ, যেগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পারিবারিক গল্প, ঠাকুরমার হাতের স্বাদ আর আত্মীয়তার গন্ধ।
কোরবানির বাকি মাংস—সম্ভারের শুরু
ঈদের দিন সন্ধ্যার পর অনেক পরিবারই মাংসের অংশ ছোট ছোট করে কেটে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করেন। কেউ রেফ্রিজারেটরে রাখেন, কেউ লবণ ও হলুদ মেখে রেখে দেন, কেউ আবার রোস্ট করে শুকিয়ে রাখেন। এই বাকি মাংসই ঈদের পরদিনের রান্নার মূল উপকরণ।
বিশেষ করে গরুর হাঁড়, চর্বি, হাড়ের গাঁটে থাকা মাংস, কলিজার ছোট টুকরো, নরোম পাঁজরের অংশ—এসব দিয়েই তৈরি হয় চমৎকার সব পদ, যেগুলো কেবল ঘরের মানুষদের জন্য। কারণ অতিথির চাপ থাকে না, সময় থাকে বেশি, আর প্রেম থাকে অগাধ।
মাংসের তেহারি—ঈদের দ্বিতীয় দিনের আবেগ
পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি পরিবারে ঈদের পরদিন কমপক্ষে একবার হলেও মাংসের তেহারি রান্না হয়। এটি কোনো সাধারণ তেহারি নয়—বরং খাঁটি কোরবানির মাংসের টুকরো দিয়ে, ভাজা পেঁয়াজ, দারুচিনি, এলাচ, এবং কেওড়া জলের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে রান্না করা এক রসনায় পরিণত পদ।
অনেক গৃহিণী এই রান্নায় পুরোনো হাঁড়ি ব্যবহার করেন, কারণ সেগুলোতে মাংসের তেল ভালোভাবে মেশে এবং ভাত ঝরঝরে হয়। আবার কেউ কেউ পাত্রের নিচে আলু ও ডিম দিয়ে তেহারিকে করে তোলেন আরও মজাদার।
চর্বি দিয়ে খিচুড়ি—অবহেলিত স্বাদের রাজা
ঈদের পরদিন অনেক বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি হয় গরুর চর্বি দিয়ে মসুর ডালের খিচুড়ি। এর ঘ্রাণই আলাদা, স্বাদও অন্যরকম। কেউ ঘি দেন, কেউ শুকনা মরিচের ভাজা তেল, আর কেউ বুড়িদের রেসিপি অনুযায়ী একটু কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন বাটা দিয়ে ঝাল রাখেন।
এই খিচুড়ির পাশে পরিবেশন করা হয় গরুর তেল-মাংস ভুনা অথবা ছোট ছোট চাপ-টুকরো। এতে থাকে এক ঘরোয়া আন্তরিকতা, একধরনের বিশ্রামের স্বাদ, যেটা ঈদের আগের ব্যস্ত দিনে পাওয়া যায় না।
কলিজা-পোস্ত, মাংসের কোপ্তা, আর গরুর হাড়ের ঝোল
অনেক পরিবারে ঈদের পরদিন কলিজা দিয়ে বানানো হয় পোস্তর ডাল, যাতে সরিষার তেল ও খসখসে পোস্তদানা থাকে। আবার কেউ বানান মাংসের কিমা দিয়ে কোপ্তা—ডিম ভর্তি গোল বল, যেগুলো কষানো ঝোলে পরিবেশন করা হয়।
আর যাদের বাড়িতে বাচ্চা বা বয়স্ক সদস্য বেশি, তাঁরা রান্না করেন গরুর হাড়ের ঝোল। এতে থাকে পাতলা ঝোল, আলু, কাঁচা মরিচ, আর অনেক অনেক ভালোবাসা।
পাড়ায় পাড়ায় চালাচালি: দ্বিতীয় দিনের ভাগাভাগিও আছে
পুরান ঢাকায় ঈদের দ্বিতীয় দিনেও খাবার ভাগাভাগির সংস্কৃতি চলে। এবার হয়তো অতিথি আসেন না, কিন্তু প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে খাবার পাঠানো হয়। “এই তেহারি একটু খাও, মাংসের চাপ ভালো হয়েছে কিনা বলো”—এইসব কথাগুলো শুধু সৌজন্য নয়, এটি অভ্যস্ত আন্তরিকতার এক প্রকাশ।
অনেক সময় পাড়া-বয়সীদের জন্য আলাদা রান্না হয়—কম ঝাল, বেশি ঝোল বা পুষ্টিকর খিচুড়ি। আবার কেউ কেউ প্রতিবেশী গৃহকর্মী বা অসুস্থ বৃদ্ধদের ঘরে আলাদা খাবার পাঠিয়ে দেন।
রান্না ছাড়াও চলে রান্নার গল্প
ঈদের দ্বিতীয় দিন যখন রান্নাঘরে অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক পরিবেশ, তখন অনেকেই গল্প করেন আগের দিনের রান্না নিয়ে। “তোমার রেজালার স্বাদটা অন্যরকম ছিল, কী মসলা দিলে?” কিংবা “চাপটা একদম যেন দাদি বানাতো যেমন”—এইসব কথোপকথন বাড়িয়ে তোলে পারিবারিক সংলাপ।
অনেকে বসে রান্নার রেসিপি নোট করেন, মেয়েরা মা বা খালার থেকে রাঁধুনি রহস্য শিখে নেন। এইভাবেই পুরান ঢাকার পরিবারগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্বাদ আর স্মৃতি হস্তান্তর করে।
উৎসব শেষ নয়, নতুন করে শুরু
ঈদের দ্বিতীয় দিনের রান্না কেবল অবশিষ্ট মাংসের ব্যবহার নয়—এটি পরিবারের ভেতরের সময় কাটানো, ধীর-প্রেমময় রান্না আর সম্পর্কের নতুন করে সুর বাঁধার এক অনন্য অধ্যায়। পুরান ঢাকায় এই দিনটিই উৎসবের পূর্ণতা দেয়।
শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরনো অঞ্চল হয়তো সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে, তবে এখানকার রান্না, স্বাদ আর ভাগাভাগির সংস্কৃতি এখনো তেমনি প্রাণবন্ত, রঙিন ও চিরন্তন।