অষ্টম পরিচ্ছেদ
বেড়ার একখানা আলগা তক্তা টেনে-হিচড়ে খুলে ফেলে সেই ফাঁক দিয়ে আমরা ভেতরের উঠোনে ঢুকে পড়লুম। কুয়োর ছাতাপড়া গর্তটার মধ্যে অনেক নিচে কালির ফোঁটার মতো চকচক করছিল জল, কিন্তু কুয়ো থেকে জল তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। একটা চালার নিচে স্তূপাকার ভাঙাচোরা লোহালক্কড়ের মধ্যে চুবুক একটা মরচে-ধরা ফুটো বালতি খুঁজে পেলেন। কিন্তু বালতিটাকে কুয়োয় নামিয়ে যখন টেনে তোলা হল তখন দেখা গেল একটুখানি তলানি জল পড়ে আছে ওটায়। ফুটোটাকে ঘাস দিয়ে কোনমতে বন্ধ করে আবার জল তোলার চেষ্টা করা হল।
এবার খানিকটা জল উঠল। জলটা পরিষ্কার আর এত ঠান্ডা যে তা আমাদের অল্প-অল্প করে চুমুক দিয়ে খেতে হল। ধুলোমাখা, ঘামে-ভেজা মুখগুলো ধুয়ে আমরা বাড়িটার কাছে গেলুম। বাড়িটার সামনের জানলাগুলো তক্তা মেরে বন্ধ করা ছিল বটে, কিন্তু বারান্দা দিয়ে উঠে দেখলুম একপাশের দরজাটা হাট করে খোলা। নিচের একটামাত্র কব্জায় ভর করে ঝুলছিল পাল্লাটা। কি’চকি’চ আওয়াজ-করা তক্তাগুলোর ওপর সাবধানে পা রেখে রেখে আমরা ভেতরে ঢুকলুম।
ভেতরে ঢুকে দেখলুম ঘরময় খড়কুটো, কাগজ আর ছোড়া ন্যাকড়া ছড়ানো।
তাছাড়া ছিল কয়েকটা ফাঁকা প্যাকিং বাক্স, একটা ভাঙা চেয়ার আর একটা সাইডবোর্ড, যার দরজাগুলো ভোঁতা আর ভারি কোনো জিনিস দিয়ে ভেঙে খোলা হয়েছে।
নিচু গলায় চুবুক বললেন, ‘চাষীরা খামারটে লুট করেচে। দরকারী সবকিছু, লিয়ে বাদবাকি জিনিস ছেড়ে গেচে।’
পাশের ঘরটায় গিয়ে দেখলুম মেঝের ওপর একগাদা বই এলোমেলোভাবে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। চটের মাদুর দিয়ে বইগুলো ঢাকা। বইগুলোর মধ্যে এক মোটাসোটা ভদ্রলোকের একটা ছে’ড়া ফোটোগ্রাফও দেখতে পেলুম। কে যেন কালিতে আঙুল ডুবিয়ে ছবির মানুষটার ফর্সা, গর্বোদ্ধত কপালে একটা অসভ্য কথা লিখে রেখেছিল।
ওই যথাসর্বস্ব লুট-করে-নেয়া, পরিত্যক্ত বাড়িটার ঘর থেকে ঘরে ঘুরে বেড়ানো ছিল ভারি অদ্ভুত আর মজার এক অভিজ্ঞতা। ওখানকার প্রতিটি টুকিটাকি জিনিস-যেমন একটা ভাঙা ফুলদানি, ভুলে-ফেলে-যাওয়া একখানা ফোটোগ্রাফ, জঞ্জালের মধ্যে ঝিলিক-দেয়া একটা বোতাম, ছড়ানো-ছিটনো, পায়ে-মাড়ানো দাবার ঘাঁটিগুলো, ভাঙা একটা জাপানি ফুলদানির টুকরোর মধ্যে একা-একা পড়ে থাকা তাসের প্যাক থেকে ছিটকে-পড়া একটা ইস্কাপনের রাজা পাড়াগাঁয়ের ওই জমিদারবাড়ির এককালের বাসিন্দাদের আর বিক্ষুব্ধ তৎকালীন বর্তমান থেকে কত আলাদা তাদের নিরুদ্বেগ অতীত জীবনের সাক্ষ্য দিচ্ছিল।