নজরুল: পরিশিষ্ট
এই খবর জানিতে পারিয়া আমি তো আকাশ হইতে পাড়িলাম। কবিপুত্রকে বলিলাম, “করিয়াছ কি? যেখানে আমি প্রকাশকদের কাছে ২৫% রয়ালটি পাই সেখানে তুমি মাত্র ১৫% রয়ালটিতে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হইলে?” কিন্তু যে দুগ্ধ মাটিতে পড়িয়া গিয়াছে, তার জন্য আর অনুতাপ করিলে কি হইবে।
এই পুস্তকখানা ছাপা হইলে বিস্মিত হইয়া দেখিলাম পুস্তকের কলেবরে প্রকাশক লিখিয়াছেন, প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণও ছাপা হইয়াছে। তাহাতেও অনুরূপ সর্বস্বত্ব প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত কথাটি লিপিবদ্ধ আছে। আমার যতদূর বিশ্বাস এই পুস্তক ছাপা হওয়ার আগে প্রকাশক যে তিন চার শত টাকা কবি-পুত্রকে দিয়াছিলেন তাহার পরে আর কোনো অর্থ কবির পরিবারকে তিনি দেন নাই। অধুনা ঢাকা হইতে কয়েকজন প্রকাশক কবির বইগুলি অবলীলাক্রমে ছাপাইয়া চলিয়াছেন। খুব সম্ভব তাঁহারা কেহই কবির পরিবারকে এজন্য কোনোই অর্থ প্রদান করেন নাই। এইভাবেই আমরা কবির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। আমাদের গভর্নমেন্টের কি এ বিষয়ে কিছুই করিবার নাই?
কলিকাতা গেলেই একবার কবিকে দেখিয়া আসি। কবির সামনে বসিয়া তাঁর কবিতাগুলি আবৃত্তি করি।
সেবার আমি অসুস্থ হইয়া কলিকাতার হাসপাতালে। হাসপাতাল হইতে ছুটি লইয়া একদিন কবিকে দেখিতে গেলাম। ভাবি কিছুতেই আমাকে দুপুরের আহার না করিয়া আসিতে দিলেন না। কবির শাশুড়ি সেই যে কবে উধাও হইয়া চলিয়া গিয়াছেন আর ফিরিয়া আসেন নাই। কবির শয্যাপার্শ্বে বসিয়া কত কথাই না মনে পড়িতে লাগিল।
ভাব-বিহ্বল কবি একবার সিনেমার অভিনেত্রী কাননবালার বাড়ি যাইয়া সেই যে রহিলেন, আর ফিরিয়া আসেন না।
প্রায় পনের-যোল দিন কাটিয়া গেল। একদিন খালাআম্মা হিজ মাস্টারস্ ভয়েসের দারোয়ান দশরথের নিকট হইতে কাননবালার ঠিকানা সংগ্রহ করিলেন। তারপর একটি ট্যাক্সিতে নিজের মেয়েকে সঙ্গে লইয়া রণরঙ্গিণীর বেশে কাননবালার বাড়ি যাইয়া উপস্থিত হইলেন। কবি বোধ হয় তখন কাননবালাকে গান শিখাইতেছিলেন। খালাআম্মা বলিতে লাগিলেন, “পাজি কোথাকার।
তোমার জন্য আমরা জাতি ছেড়েছি, ধর্ম ছেড়েছি। আমার মেয়ে কলঙ্কের ডালা মাথায় করে একদিন তোমার ঘর করতে এসেছিল, আর তাকে ভুলে আজ তুমি একজন সিনেমার অভিনেত্রীর ঘরে বসে আছ? শিগগির গাড়িতে যেয়ে ওঠ।” অনুগত বিড়ালটির মতো কবি যাইয়া গাড়িতে বসিলেন। কবি সেই যে কাননবালার গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন আর সেখানে কখনও ফিরিয়া যান নাই।
খালাআম্মার মতো ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন মহিলা আর কোথাও দেখি নাই। এত বড় যে বিদ্রোহী কবি তাঁকে খালাআম্মা যেন হাতের পুতুলটি করিয়া রাখিয়াছিলেন। এই পুতুল মাঝে মাঝে সকল মমতার বাঁধন কাটিয়া গিয়াছেন। খালাআম্মা আবার তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়াছেন। কিন্তু খালাআম্মা যে চিরজনমের মতো অভিমান করিয়া চলিয়া গেলেন আর কেহই তাঁহাকে ফিরাইয়া আনিতে পারিল না। কবি যদি সুস্থ হইয়া উঠিতেন তবে হয়তো তিনি খালাআম্মাকে আবার ফিরাইয়া আনিতে পারিতেন।
চলবে…..