জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল (United Nations Human Rights Council—UNHRC) বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, নথিবদ্ধ করা এবং উন্নত করার দায়িত্ব পালন করে। বিশেষ করে যেসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে—সেখানে এই কাউন্সিল স্থানীয় অফিস স্থাপন করে। উদাহরণ হিসেবে গাজা বা অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রকে ধরা যায়। কিন্তু কেন এ ধরনের দেশে স্থানীয় অফিস খোলা হয়?
পর্যবেক্ষণ এবং তথ্যসংগ্রহ
প্রথম ও প্রধান কারণ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ। দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ বা তৃতীয় পক্ষের প্রতিবেদন প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্ট বা অসম্পূর্ণ হতে পারে। স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা সরাসরি ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে নির্ভুল তথ্য নথিবদ্ধ করা সম্ভব হয়।
উদাহরণস্বরূপ, গাজায় সংঘাতের সময় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা, হাসপাতাল ধ্বংস, জল-বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়া অথবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি—সবই ময়দানে সরেজমিন উপস্থিতি ছাড়া নির্ভুলভাবে নথিবদ্ধ করা কঠিন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথি ও প্রমাণ
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত বা তদন্ত কমিশন প্রমাণের ওপর নির্ভর করে। স্থানীয় অফিস সরাসরি সাক্ষ্য গ্রহণ, ভিডিও ও স্থিরচিত্র সংগ্রহ, ঘটনার তারিখ-সময় নথিবদ্ধ করে, যাতে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অপরাধীদের জবাবদিহি করানো যায়।
যেমন, সাবেক যুগোস্লাভিয়া বা রুয়ান্ডায় গণহত্যার সময় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ মিশন ছিল অপরিহার্য। গাজা বা সিরিয়ার মতো বর্তমান সংঘাতক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
ভুক্তভোগীদের সহায়তা ও নিরাপত্তা
স্থানীয় অফিস খোলার আরেকটি কারণ হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছানো। নির্যাতিত ব্যক্তি বা পরিবারকে সহায়তার পথ বাতলে দেওয়া, আইনি সহায়তার জন্য সংযোগ স্থাপন, আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়—সবই এই অফিসের দায়িত্বের অংশ।
বিশেষ করে শরণার্থী শিবির বা অবরুদ্ধ শহরে থেকে যাওয়া মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকি চিহ্নিত করা এবং ত্রাণ পৌঁছানোতেও এই অফিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি
যখন কোনো দেশে স্থানীয় অফিস খোলা হয়, সেটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক বার্তা দেয়—বিশ্ব নজর রাখছে। কোনো সরকার যদি বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন চালায় বা কোনো পক্ষ বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যে করে হামলা করে, তাহলে এই উপস্থিতি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বা বিবৃতির ওপর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, রাষ্ট্র, দাতা সংস্থা, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদও নজর রাখে। ফলে কোনো রাষ্ট্র বা পক্ষ মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে তা গোপন রাখা কঠিন হয়ে যায়।
মধ্যস্থতা ও শান্তি প্রচেষ্টা
মানবাধিকার কাউন্সিলের স্থানীয় অফিস অনেক সময় শান্তি-আলোচনা বা যুদ্ধবিরতির সরাসরি মধ্যস্থতাকারী হয় না, তবে প্রক্রিয়াটিকে কার্যকরভাবে সহায়তা করে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নকে শর্ত হিসেবে রেখে যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আলোচনায় টেনে আনা হয়।
যেমন, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ, যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি, মানবিক করিডোর খোলা—এসব ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের অফিস স্থানীয়ভাবে পক্ষগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে।
স্থানীয় সমাজের ক্ষমতায়ন
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়। এতে স্থানীয় সমাজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক ধরনের প্রতিরোধ-ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
গাজা বা ইয়েমেনের মতো জায়গায় স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রকাশ করা সম্ভব হয়।
জাতিসংঘের মতে, মানবাধিকার সুরক্ষা ছাড়া টেকসই শান্তি সম্ভব নয়—এ কারণেই সংঘাতময় দেশে এ ধরনের স্থানীয় অফিসের উপস্থিতি অপরিহার্য।