গত দশ মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও শহরে নারী ও কিশোরীদের ওপর ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, এই সময়ে সহস্রাধিক নারী স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল এবং চলার পথে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন। যদিও প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ অনেকেই সামাজিক লজ্জা বা হুমকির ভয়ে অভিযোগ জানাতে সাহস পান না।
ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে নারীর মনে যে মানসিক ও স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া হয়, তা প্রায়ই তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ইভ টিজিংয়ের ঘটনার পর আক্রান্ত নারীর মনে তীব্র আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা, লজ্জা, অপরাধবোধ এবং হতাশার সঞ্চার হয়। এই মানসিক আঘাত থেকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি), তীব্র উদ্বেগ, আতঙ্কের অনুভূতি, ঘুমের ব্যাঘাত ও বিষণ্ণতা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে যারা অল্পবয়সী এবং পূর্বে এমন অভিজ্ঞতা না পেয়েছেন, তাদের জন্য এই আঘাত মানসিক বিকাশের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে।
একজন নারী যদি প্রকাশ্য স্থানে বা গণপরিবহনে ইভ টিজিংয়ের শিকার হন, তখন তার মস্তিষ্কের ‘অ্যামিগডালা’ অংশ হঠাৎ সক্রিয় হয়ে যায়। এটি মানুষের আতঙ্ক ও বিপদের সাড়া প্রদানের কেন্দ্র। ফলে নারীর দেহে কর্টিসল এবং অ্যাড্রিনালিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সুরক্ষার উপায় খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে। এ অবস্থায় কোনো কোনো নারী আতঙ্কে জড়িয়ে যেতে পারেন, আবার কেউ কাঁদতে শুরু করেন বা এলোমেলো আচরণ করেন। দীর্ঘমেয়াদে এই অবস্থা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, সমাজবিমুখতা এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রে সঙ্কোচ তৈরি করতে পারে।
মানবাধিকারকর্মী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন ইভ টিজিং একটি সমাজে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে এবং অপরাধীরা প্রকাশ্যে থেকে যায়, তখন সেটি কেবল একজন ব্যক্তির নয়, গোটা সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা নষ্ট করে। এর ফলে নারী শিক্ষার পরিবেশ বিপন্ন হয়, কর্মক্ষেত্রের অংশগ্রহণে ভয় তৈরি হয় এবং নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে অমিশ্রণ ও অনাস্থা জন্ম নেয়।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওশন আরা খাতুন বলেন, “যে রাষ্ট্রে ইভ টিজিং নিয়মিত ও বিচারহীনভাবে ঘটে, সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে যায়। এটি রূঢ় এবং সহিংস মানসিকতার মানুষের আধিপত্য তৈরি করে। সময়ের সঙ্গে এই প্রক্রিয়া সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।”
কিছু বিশেষজ্ঞের মত, এ ধরনের পরিস্থিতি একটি সমাজকে ‘রাফ স্টেট’ বা রূঢ় রাষ্ট্রের চিত্রে পরিণত করে। এখানে আইনের শাসন দুর্বল হয় এবং সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচারের পরিবর্তে আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করতে থাকে। কোনো সমাজ যত বেশি ইভ টিজিং ও নারী নির্যাতনকে সহ্য করে, তত বেশি সেখানে সামাজিক অবক্ষয় গতি পায়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, ইভ টিজিং-এর শিকার নারীদের তাত্ক্ষণিক কাউন্সেলিং, পরিবার ও বন্ধুমহলের সমর্থন, এবং আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি সমাজের মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর এবং শিশু-কিশোরদের স্কুল পর্যায়ে নারী-সম্মানবোধ শেখানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
এছাড়া, সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগ, অপরাধীর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিতকরণ এবং সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশের দাবিও জোরালো হচ্ছে। কারণ এই প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইভ টিজিং এর লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত শুধু নারীর জন্য নয়, গোটা জাতির সামাজিক স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি ভয়ঙ্কর বার্তা। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এটি ভবিষ্যতে আরও গভীর সঙ্কটের জন্ম দিতে পারে।