০৪:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-২৪৭) চীনকে কেন্দ্র করে কোয়াডের আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের উদ্যোগ কোয়াড সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যোগদানের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও থাই-ক্যাম্বোডিয়ান সীমান্তে সংঘর্ষ অব্যাহত হিউএনচাঙ (পর্ব-১৫৭) রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৫) শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকীর ৫৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন ‘জেন জি’ তরুণরা অধিকাংশ ডানপন্থী রাজনীতি করে: সমস্যা প্রেমে ও ডেটে যুক্তরাষ্ট্র-হামাস আলোচনায় অচলাবস্থা, গাজা ও ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে কূটনৈতিক ব্যস্ততা নদীতে ভাসমান হাট: বরিশাল ও ঝালকাঠির নৌপথে কৃষিপণ্যের জীবন্ত সংস্কৃতি

নদীতে ভাসমান হাট: বরিশাল ও ঝালকাঠির নৌপথে কৃষিপণ্যের জীবন্ত সংস্কৃতি

নদীমাতৃক অঞ্চলের অনন্য ঐতিহ্য

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলা, নদীবেষ্টিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে জীবনের প্রতিটি ছন্দে নদী জড়িয়ে আছে। কৃষিকাজ, যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুই নদীকেন্দ্রিক। এই অঞ্চলের কৃষিজ পণ্যের বাজারও নদীর বুকেই গড়ে উঠেছে। নদীতে ভাসমান হাট বা নৌকা বাজার দক্ষিণাঞ্চলের এক অনন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঐতিহ্য, যা কেবল ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান নয়, বরং একটি জীবনযাত্রার ছায়া।

কীর্তনখোলাসন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীতে ভাসমান বাজারের বিস্তার

বরিশালের কীর্তনখোলা নদী এবং ঝালকাঠির সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ভাসমান বাজার। সাধারণত ভোরের দিকে এই বাজার শুরু হয়, চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর এবং ঝালকাঠির নলছিটি ও রাজাপুরের নানা স্থান থেকে কৃষক ও পাইকাররা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে নদীতে এসে হাজির হন। তাদের নৌকায় বোঝাই থাকে নানা ধরনের কৃষিপণ্য— পেয়ারা, মূলা, লাউ, কচু, শসা, কাঁকরোল, বরবটি, লেবু, ধনেপাতা, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেলসহ আরও বহু কিছু।

ক্রেতা-বিক্রেতার জমজমাট রেওয়াজ

এই ভাসমান হাটে ক্রেতারাও আসেন নৌকায় করে। কোনো কোনো ক্রেতা নিজেই খুচরা বিক্রেতা, কেউবা আবার পাইকার। যারা স্থলভাগের বাজারে নিতে চান, তারা নৌকা থেকে পণ্য কিনে আবার অন্য নৌকায় বা ঘাটে গিয়ে নামিয়ে নিয়ে যান। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় পণ্য হাতবদল হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই লেনদেন হয় একেবারে মুখে মুখে—কোনো দালাল নেই, দামের দর কষাকষি হয় সরাসরি কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে।

কৃষকের লাভপরিবেশের উপকার

ভাসমান বাজারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রি করতে পারেন, কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই। এতে কৃষকের লাভ বাড়ে এবং শহরের ভোক্তারাও পান তুলনামূলক কম দামে তাজা সবজি ও ফল। সেই সঙ্গে পরিবেশের জন্যও এটি উপকারী, কারণ এতে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো বা বাজার বসানোর প্রয়োজন হয় না; নদীই এখানে বিপণন কেন্দ্র।

পর্যটনের সম্ভাবনা

বরিশালের ভাসমান হাট পর্যটকদের কাছেও বাড়তি আকর্ষণ। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক এই হাট দেখতে আসেন। স্থানীয় প্রশাসন এবং পর্যটন করপোরেশন এ হাটকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠির ভীমরুলি ও নলছিটি এলাকায় এখন প্রায় সারা বছরই কোনো না কোনো নৌকাবাজার চলমান থাকে। বর্ষা মৌসুমে এ হাট আরও চাঙা হয়ে ওঠে।

চ্যালেঞ্জ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন

তবে এই ভাসমান হাটগুলোর সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, অবৈধ দখল, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনিয়মিত বর্ষণ, বন্যা কিংবা খরার প্রভাব কৃষিপণ্যের উৎপাদন এবং পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। নদীর পাড়ে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার কারণে অনেক সময় পানি দূষণের শিকার হয় এই অঞ্চল, যা কৃষি ও নৌপথ উভয়ের জন্যই হুমকি।

নদীই জীবননদীই বাজার

বরিশাল ও ঝালকাঠির ভাসমান কৃষিপণ্যের বাজার শুধু বাণিজ্যিক নয়, এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন। নদী যেখানে শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, বরং বাজারের প্ল্যাটফর্ম—সেই জায়গায় এই হাটগুলি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ বাংলার পরিচয় ও গর্বের প্রতীক। যথাযথ পরিকল্পনা, নৌপথ সংরক্ষণ এবং কৃষকদের সহায়তার মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব—যা একদিকে কৃষি অর্থনীতিকে চাঙা করবে, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব বাজার ব্যবস্থার উদাহরণ হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য।

প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-২৪৭)

নদীতে ভাসমান হাট: বরিশাল ও ঝালকাঠির নৌপথে কৃষিপণ্যের জীবন্ত সংস্কৃতি

০৫:৩০:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

নদীমাতৃক অঞ্চলের অনন্য ঐতিহ্য

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলা, নদীবেষ্টিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে জীবনের প্রতিটি ছন্দে নদী জড়িয়ে আছে। কৃষিকাজ, যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুই নদীকেন্দ্রিক। এই অঞ্চলের কৃষিজ পণ্যের বাজারও নদীর বুকেই গড়ে উঠেছে। নদীতে ভাসমান হাট বা নৌকা বাজার দক্ষিণাঞ্চলের এক অনন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঐতিহ্য, যা কেবল ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান নয়, বরং একটি জীবনযাত্রার ছায়া।

কীর্তনখোলাসন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীতে ভাসমান বাজারের বিস্তার

বরিশালের কীর্তনখোলা নদী এবং ঝালকাঠির সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ভাসমান বাজার। সাধারণত ভোরের দিকে এই বাজার শুরু হয়, চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর এবং ঝালকাঠির নলছিটি ও রাজাপুরের নানা স্থান থেকে কৃষক ও পাইকাররা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে নদীতে এসে হাজির হন। তাদের নৌকায় বোঝাই থাকে নানা ধরনের কৃষিপণ্য— পেয়ারা, মূলা, লাউ, কচু, শসা, কাঁকরোল, বরবটি, লেবু, ধনেপাতা, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেলসহ আরও বহু কিছু।

ক্রেতা-বিক্রেতার জমজমাট রেওয়াজ

এই ভাসমান হাটে ক্রেতারাও আসেন নৌকায় করে। কোনো কোনো ক্রেতা নিজেই খুচরা বিক্রেতা, কেউবা আবার পাইকার। যারা স্থলভাগের বাজারে নিতে চান, তারা নৌকা থেকে পণ্য কিনে আবার অন্য নৌকায় বা ঘাটে গিয়ে নামিয়ে নিয়ে যান। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় পণ্য হাতবদল হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই লেনদেন হয় একেবারে মুখে মুখে—কোনো দালাল নেই, দামের দর কষাকষি হয় সরাসরি কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে।

কৃষকের লাভপরিবেশের উপকার

ভাসমান বাজারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রি করতে পারেন, কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই। এতে কৃষকের লাভ বাড়ে এবং শহরের ভোক্তারাও পান তুলনামূলক কম দামে তাজা সবজি ও ফল। সেই সঙ্গে পরিবেশের জন্যও এটি উপকারী, কারণ এতে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো বা বাজার বসানোর প্রয়োজন হয় না; নদীই এখানে বিপণন কেন্দ্র।

পর্যটনের সম্ভাবনা

বরিশালের ভাসমান হাট পর্যটকদের কাছেও বাড়তি আকর্ষণ। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক এই হাট দেখতে আসেন। স্থানীয় প্রশাসন এবং পর্যটন করপোরেশন এ হাটকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠির ভীমরুলি ও নলছিটি এলাকায় এখন প্রায় সারা বছরই কোনো না কোনো নৌকাবাজার চলমান থাকে। বর্ষা মৌসুমে এ হাট আরও চাঙা হয়ে ওঠে।

চ্যালেঞ্জ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন

তবে এই ভাসমান হাটগুলোর সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, অবৈধ দখল, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনিয়মিত বর্ষণ, বন্যা কিংবা খরার প্রভাব কৃষিপণ্যের উৎপাদন এবং পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। নদীর পাড়ে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার কারণে অনেক সময় পানি দূষণের শিকার হয় এই অঞ্চল, যা কৃষি ও নৌপথ উভয়ের জন্যই হুমকি।

নদীই জীবননদীই বাজার

বরিশাল ও ঝালকাঠির ভাসমান কৃষিপণ্যের বাজার শুধু বাণিজ্যিক নয়, এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন। নদী যেখানে শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, বরং বাজারের প্ল্যাটফর্ম—সেই জায়গায় এই হাটগুলি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ বাংলার পরিচয় ও গর্বের প্রতীক। যথাযথ পরিকল্পনা, নৌপথ সংরক্ষণ এবং কৃষকদের সহায়তার মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব—যা একদিকে কৃষি অর্থনীতিকে চাঙা করবে, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব বাজার ব্যবস্থার উদাহরণ হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য।