বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ছোট্ট উপজেলা টেকনাফ। কক্সবাজার জেলার এই জনপদ এখন শুধু পর্যটনের জন্য নয়, বরং এক বিষাক্ত চোরাচালান পথের নাম—যেখানে ইয়াবা নামক এক মরণনেশা প্রতিদিন প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। আর এর পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত ও সহিংস চক্র।
ইয়াবা আসে কোথা থেকে?
ইয়াবা মূলত উৎপন্ন হয় মিয়ানমারের শান রাজ্যে, যেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো—বিশেষ করে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য জাতিগত মিলিশিয়ারা—মাদক উৎপাদনের পাশাপাশি অস্ত্র কেনাবেচা ও বিদ্রোহ পরিচালনার অর্থ জোগাড় করে। সেখান থেকে ইয়াবা পরিবাহিত হয় আরাকান রাজ্যের মংডু ও সিত্তে শহরের মধ্য দিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে।
এই পিলগুলো অত্যন্ত সহজে বহনযোগ্য—ছোট, রঙিন, গন্ধহীন—যা সহজেই শরীরে, ব্যাগে বা পণ্যসামগ্রীর ভেতর লুকিয়ে আনা যায়।
টেকনাফ সীমান্ত: পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য
নাফ নদীর উপকূলে টেকনাফ উপজেলার অন্তত ৪০টি ‘অফিশিয়াল ও অনানুষ্ঠানিক’ সীমান্তপথ রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই মাদক পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। রাতের অন্ধকারে নৌকা কিংবা ট্রলারযোগে এইসব ইয়াবা চালান টেকনাফে আসে। এরপর স্থানীয় চক্রগুলো তা সরবরাহ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে।
বলা হয়ে থাকে, ইয়াবা পাচারের জন্য এখানে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করে। একসময় সংসদ সদস্য হিসেবেও যিনি টেকনাফ-উখিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তিনিও এই সিন্ডিকেটের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে সন্দেহের কেন্দ্রে ছিলেন।
রোহিঙ্গা শিবির ও পাচারপথের সংযোগ
২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনা অভিযানের পর প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এই বিশাল জনগোষ্ঠী কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বসবাস করছে শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই মানবিক সংকটকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে ইয়াবা সিন্ডিকেটগুলো।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের পর অন্তত ৫০০ জন চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি রোহিঙ্গা পরিচয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অনেক রোহিঙ্গা যুবক—যারা চাকরি, খাবার কিংবা সুরক্ষার অভাবে বিপর্যস্ত—তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে ইয়াবা বহনের জন্য।
উপজেলার একাধিক মামলার তথ্যে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরের ভিতর থেকেও মাদক পাচারের নির্দেশনা, পরিকল্পনা এবং বিতরণ কাজ পরিচালিত হচ্ছে। মোবাইল ফোন, সিম কার্ড, ও অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট দেশের অভ্যন্তরে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
গরিবি আর অনিশ্চয়তার সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা
রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো আইনি কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে পাচারকারীরা কিছু টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ইয়াবা বহনের কাজে তাদের নিয়োজিত করে। অনেকে মাত্র ২-৩ হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নদী পার হয়ে ইয়াবা বহন করে।
বছরের পর বছর এই ব্যবস্থায় কাজ করার ফলে এখন রোহিঙ্গা যুবকদের একটি অংশ ইয়াবা সিন্ডিকেটের নিয়মিত অংশীদার হয়ে উঠেছে। এমনকি শিবিরে ইয়াবা সেবনের সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ফলে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে, সংঘর্ষ ঘটছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটছে।
নিরাপত্তা ও সামাজিক অস্থিরতা
বাংলাদেশে ইয়াবা এখন আর শুধু সীমান্তীয় সমস্যা নয়—এটি এক ভয়াবহ জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম, ছাত্র, দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী—সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই ইয়াবা সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। পুলিশের তথ্য মতে, প্রতি বছর কোটি কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হলেও মূল চক্র এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা শিবিরের ভিতরেও ইয়াবা চক্রকে কেন্দ্র করে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, খুনাখুনি এবং গ্যাং সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও জনবল সংকটে পড়ছে।
করণীয় ও ভবিষ্যৎ ভাবনা
এই চক্র ভাঙতে হলে শুধু অভিযান চালালেই চলবে না। শরণার্থী শিবিরে বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রযুক্তি জোরদারকরণ, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি, এবং একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি।
মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে এই মাদকের উৎপাদন কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা উদ্যোগ না নিলে কক্সবাজার সীমান্তে ইয়াবার স্রোত থামবে না।
টেকনাফ এখন আর শুধুই একটি সীমান্ত শহর নয়—এটি এখন মরণনেশা ইয়াবার প্রধান প্রবেশদ্বার। এখানে দারিদ্র্য, মানবিক সংকট ও অপরাধ একসাথে মিলেমিশে এক অন্ধকার জগত তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের জীবনের অনিশ্চয়তা, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা যদি রোধ না করা যায়, তবে এই অন্ধকার আরও দীর্ঘ হবে।