০২:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
রেস্টুরেন্ট বুকিং নিয়ে নতুন বিতর্ক: বিলাসিতা নাকি বাজারের বাস্তবতা? রাজা সীতারাম রায়: যশোরের স্বাধীন রাজ্যের সাহসী রাজা রহস্যময় রাতের যাত্রা: এক রোমাঞ্চকর রাত বান্দরবানে সোমেশ্বরী নদী: পাহাড়ি ঢল, পাথরের খনি ও পর্যটনের সম্ভাবনা কপিল দেবের মতো নন জাদেজা: সিধুর কঠোর সমালোচনা রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৮) নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন: বাংলাদেশে হামলায় বিদেশিদের লক্ষ্য করেছিল আইএস কে-পপের স্টাইল আইকন: ছোট্ট এক চুলের স্টাইলেই ভাইরাল এস্পার উইন্টার মার্বেল বিড়াল — দুর্লভ রহস্যের ছায়া উপকূলে নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা ও জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে ডেনমার্কের সহায়তায় ব্র্যাকের ‘রেইন ফর লাইফ’

যশোরের বানর: দুই শতাব্দীর পেছনে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাণীকুল

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোর একসময় নানা বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে এই অঞ্চলে প্রচুর বানর দেখা যেত—বিশেষত সাধারণ লাঙ্গুর (Hanuman Langur বা Semnopithecus entellus) ও রেসাস মাকাক (Macaca mulatta) প্রজাতির। প্রায় ২০০ বছর আগে, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর, ঝিকরগাছা, চৌগাছা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন বন, গ্রামীণ পথ ও মন্দিরপাড়ায় এসব বানরের দল অবাধে বিচরণ করত। এই প্রাণীগুলো স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল।

বানরের প্রজাতি ও সামাজিক সম্পর্ক

যশোর অঞ্চলে মূলত দুটি বানর প্রজাতি দেখা যেত। একটি হলো সাধারণ লাঙ্গুর বা হনুমান লাঙ্গুর—যারা গাছপালায় বিচরণ করত, আরেকটি হলো রেসাস মাকাক, যারা অপেক্ষাকৃত চঞ্চল স্বভাবের এবং গ্রামীণ জনবসতিতে প্রায়ই মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করত। হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে হনুমান লাঙ্গুরকে ‘হনুমান দাদা’ হিসেবে পূজা করা হতো, ফলে এসব বানর অবাধে গ্রামে চলাফেরা করত এবং অনেক হিন্দু পরিবার তাদের প্রতিদিন কলা, চিঁড়ে বা ফল খাওয়াত। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বানরের প্রতি মানুষের এক ধরনের সহানুভূতি ও সামাজিক রক্ষাকবচ তৈরি হয়েছিল।

সংখ্যা হ্রাসের সূচনা

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের কারণে যশোর জেলা থেকে বহু হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসন করে। এই হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল বানরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক—তারা খাবার দিত, কখনো আশ্রয় দিত, এমনকি বানর মারা গেলে ধর্মীয় রীতিতে দাহও করত। হিন্দুদের অভিবাসনের ফলে বানরগুলো সামাজিক নিরাপত্তা ও খাদ্য সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বনাঞ্চলের দ্রুত হ্রাস, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, রাস্তা নির্মাণ, এবং বিদ্যুতের খুঁটি বসানোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গাছ কেটে ফেলার কারণে বানরের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস হতে থাকে।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে যশোর জেলায় বানরের উপস্থিতি অত্যন্ত সীমিত। ২০১৩ সালের একটি ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় মাত্র ৫ থেকে ৭টি লাঙ্গুর গোষ্ঠী টিকে আছে, যার প্রতিটি দলে ৮ থেকে ২০টি বানর রয়েছে। অনেক সময় স্থানীয় জনগণ এখন বানরদের উচ্ছেদ করতে চায়, কারণ তারা ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে, ঘরে ঢুকে পড়ে বা লোকজনকে বিরক্ত করে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় সামাজিক সহানুভূতিও অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।

দেশজুড়ে বর্তমানে সাধারণ লাঙ্গুর বা হনুমান লাঙ্গুরের সংখ্যা ২০০-এর নিচে বলে ধারণা করা হয়। যশোরে এই সংখ্যা সম্ভবত ৫০ থেকে ৭০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। রেসাস মাকাকের উপস্থিতিও এই জেলায় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কালের সাক্ষী

যশোর জেলার বানর জনসংখ্যার পতন শুধুই প্রাকৃতিক বাসস্থান হারানো বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে গভীর সামাজিক পরিবর্তন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিবাসনের ফলে বানরের প্রতি সহানুভূতি ও যত্নের ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, অবকাঠামো নির্মাণ এবং মানুষের আচরণগত পরিবর্তন মিলিয়ে একটি প্রাচীন প্রাণীকুল আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যশোরের বানর আজ শুধু কালের সাক্ষী নয়, বরং এক হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির প্রতীকও।

 

রেস্টুরেন্ট বুকিং নিয়ে নতুন বিতর্ক: বিলাসিতা নাকি বাজারের বাস্তবতা?

যশোরের বানর: দুই শতাব্দীর পেছনে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাণীকুল

০৩:৩৮:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোর একসময় নানা বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে এই অঞ্চলে প্রচুর বানর দেখা যেত—বিশেষত সাধারণ লাঙ্গুর (Hanuman Langur বা Semnopithecus entellus) ও রেসাস মাকাক (Macaca mulatta) প্রজাতির। প্রায় ২০০ বছর আগে, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর, ঝিকরগাছা, চৌগাছা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন বন, গ্রামীণ পথ ও মন্দিরপাড়ায় এসব বানরের দল অবাধে বিচরণ করত। এই প্রাণীগুলো স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল।

বানরের প্রজাতি ও সামাজিক সম্পর্ক

যশোর অঞ্চলে মূলত দুটি বানর প্রজাতি দেখা যেত। একটি হলো সাধারণ লাঙ্গুর বা হনুমান লাঙ্গুর—যারা গাছপালায় বিচরণ করত, আরেকটি হলো রেসাস মাকাক, যারা অপেক্ষাকৃত চঞ্চল স্বভাবের এবং গ্রামীণ জনবসতিতে প্রায়ই মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করত। হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে হনুমান লাঙ্গুরকে ‘হনুমান দাদা’ হিসেবে পূজা করা হতো, ফলে এসব বানর অবাধে গ্রামে চলাফেরা করত এবং অনেক হিন্দু পরিবার তাদের প্রতিদিন কলা, চিঁড়ে বা ফল খাওয়াত। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বানরের প্রতি মানুষের এক ধরনের সহানুভূতি ও সামাজিক রক্ষাকবচ তৈরি হয়েছিল।

সংখ্যা হ্রাসের সূচনা

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের কারণে যশোর জেলা থেকে বহু হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসন করে। এই হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল বানরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক—তারা খাবার দিত, কখনো আশ্রয় দিত, এমনকি বানর মারা গেলে ধর্মীয় রীতিতে দাহও করত। হিন্দুদের অভিবাসনের ফলে বানরগুলো সামাজিক নিরাপত্তা ও খাদ্য সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বনাঞ্চলের দ্রুত হ্রাস, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, রাস্তা নির্মাণ, এবং বিদ্যুতের খুঁটি বসানোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গাছ কেটে ফেলার কারণে বানরের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস হতে থাকে।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে যশোর জেলায় বানরের উপস্থিতি অত্যন্ত সীমিত। ২০১৩ সালের একটি ক্ষেত্রপর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় মাত্র ৫ থেকে ৭টি লাঙ্গুর গোষ্ঠী টিকে আছে, যার প্রতিটি দলে ৮ থেকে ২০টি বানর রয়েছে। অনেক সময় স্থানীয় জনগণ এখন বানরদের উচ্ছেদ করতে চায়, কারণ তারা ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে, ঘরে ঢুকে পড়ে বা লোকজনকে বিরক্ত করে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় সামাজিক সহানুভূতিও অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।

দেশজুড়ে বর্তমানে সাধারণ লাঙ্গুর বা হনুমান লাঙ্গুরের সংখ্যা ২০০-এর নিচে বলে ধারণা করা হয়। যশোরে এই সংখ্যা সম্ভবত ৫০ থেকে ৭০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। রেসাস মাকাকের উপস্থিতিও এই জেলায় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কালের সাক্ষী

যশোর জেলার বানর জনসংখ্যার পতন শুধুই প্রাকৃতিক বাসস্থান হারানো বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে গভীর সামাজিক পরিবর্তন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিবাসনের ফলে বানরের প্রতি সহানুভূতি ও যত্নের ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, অবকাঠামো নির্মাণ এবং মানুষের আচরণগত পরিবর্তন মিলিয়ে একটি প্রাচীন প্রাণীকুল আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যশোরের বানর আজ শুধু কালের সাক্ষী নয়, বরং এক হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির প্রতীকও।